যারা গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালোবাসেন তারা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস’ অবশ্যই পড়ে থাকবেন। কুকুর প্রজাতির মধ্যে ক্ষিপ্র-শিকারি হিসেবে হাউন্ডের নাম বিশ্ববিখ্যাত। জানেন কি বাংলাদেশেও নিজস্ব স্বকীয়তার হাউন্ড রয়েছে। অনেকে নামও শুনেছেন, হ্যাঁ, বলছি সরাইল হাউন্ডের কথা। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের এই হাউন্ড প্রজাতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কুকুর পোষেন যারা তাদের অনেকেই ছুটে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এই হাউন্ডের খোঁজে। এরপর আর এই সরাইল হাউন্ডদের নিয়ে কোনো সারাশব্দ তেমন চোখে পড়েনি। তবে সম্প্রতি সায়েন্স বি নামের বিজ্ঞান বিষয়ক মাধ্যমের ফেসবুক পেইজে সরাইল হাউন্ড নিয়ে একটি ছোট নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্টে অনেকেই সরাইল হাউন্ড নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন, এই প্রজাতি রক্ষায় আগ্রহ দেখিয়েছেন।
সায়েন্স বি-তে প্রকাশিত নিবন্ধটিতে লেখা হয়েছে:
“ …বাংলাদেশের জাতীয় কুকুর হিসেবে খ্যাত সরাইল হাউন্ড এর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। লম্বা, পাতলা গড়ন, সরু মাথা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর শিকারের অসাধারণ দক্ষতা এই কুকুরগুলোকে বিশেষত্ব দিয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে এই কুকুরগুলো আমাদের দেশের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা থেকে এই কুকুরের নাম এসেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত প্রজাতি না হওয়ায় এদের কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নাম নেই। এটি মূলত একটি ঐতিহ্যবাহী জাত।

ধারণা করা হয়, মোঘল আমলে অথবা আরব বণিকদের মাধ্যমে এই কুকুরগুলো বাংলাদেশে আসে। এদের পূর্বপুরুষ হিসেবে গ্রেহাউন্ড এবং সাইটহাউন্ড কুকুরদের কথা বলা হয়, তবে এই প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে খুব বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিছু গবেষক বলেন সরাইল হাউন্ড, সালুকি (এক ধরণের সাইটহাউন্ড) এবং স্থানীয় বন্য কুকুরের ক্রস, যা ব্রিটিশ আমলে গ্রেহাউন্ডের সাথে যুক্ত হয়েছিল।
সরাইল হাউন্ড শারীরিক ভাবে লম্বা, রোগা, এদের বুক শক্তিশালী, কান তীক্ষ্ম এবং লোম দুই রঙের। এদের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং এরা শিকারের জন্য বিখ্যাত।”
নিবন্ধটিতে আরেকটি মজার মিথও তুলে ধরা হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ.জি. ওসমানীরও দুটি সরাইল হাউন্ড ছিল, যার একটি দরজায় পাকিস্তানি আর্মির উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে তাঁর জীবন রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল বলে জানা যায়।”
সায়েন্স বি সরাইল হাউন্ডের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে জানিয়েছে, “…ব্রিডারদের অভাবে অন্যান্য স্থানীয় জাতের কুকুরের সাথে সরাইল হাউন্ডের প্রজননের ফলে জাতটি বিশুদ্ধতা হারাচ্ছে। কিছু হিসাব অনুযায়ী, মাত্র কয়েক ডজন সরাইল হাউন্ড বেঁচে আছে। এদের পালন করা অনেক ব্যয়বহুল। একদিকে বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় কুকুর পালনের জমির যেমন অভাব রয়েছে, আরেকদিকে প্রজাতিটি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগেরও অভাব রয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে সরাইল হাউন্ড প্রজননের একটি ব্যর্থ চেষ্টার পর থেকে সরকার আর এদের সংরক্ষণে তেমন কোনো বরাদ্দ দেয়নি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ দেখা যায়। Sarail Hounds of Bangladesh ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে কুকুর সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় করে প্রজননের ব্যবস্থা করেন অনেকে।…”
সরাইল হাউন্ড রক্ষার তাগিদ দিয়ে ফেসবুক পোস্টে লেখা হয়েছে, “এই প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি। অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন এবং জেনেটিক এক্সপার্টদের গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে এদের রক্ষা করা সম্ভব। এই কুকুরগুলো শুধু একটি প্রজাতি নয়, আমাদের ইতিহাসের অংশ। আসুন, সবাই মিলে এই অবহেলিত প্রাণীগুলোর প্রতি সহনশীল হই, অহেতুক তাদের প্রাণে না মারি।”
এই পোস্টের মন্তব্যে অনেকেই সরাইল হাউন্ড রক্ষায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। রাকিব নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন , “সরাইল হাউন্ড রক্ষায় একজোড়া সরাইল হাউন্ড আমি নিতে চাই। এদের উপযুক্ত সেবা সশ্রুসার মাধ্যমে ব্রিড করিয়ে বিলুপ্তি থেজে বাঁচানো দরকার!!!”
নাসিম হাসান নামের আরেকজন সরাইল হাউন্ড পালনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ব্যক্তিগত অভিমত জানিয়ে লিখেছেন, “সরাইল হাউন্ড রক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ঐ এলাকার মানুষ। এক কুকুর বিক্রি করেই তারা বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে যেতে চায়।”
মঈন উদ্দিন নামের একজন লিখেছেন, “সরাইল হাউন্ড আমাদের ঐতিহ্যের অংশ, সংরক্ষণে সচেতনতা ও উদ্যোগ জরুরি। এদের রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব।”