সকাল সকাল অফিসের ডাইনিংয়ে অভ্যাসবশত এক কাপ চা নিয়ে বসতেই সামনের জানালা দিয়ে চোখ গেলো কাছের শিল কড়ই গাছটির দিকে। শীতে গাছটির পাতাহীন ডালে নাচছে এক সবুজ পাখি, চোখে টেনে কাজল দিয়েছে, গলায় আকাশি পালক, সেখানেও এক ছোপ হাল্কা বাঁকা কাজলকালো দাগ। এমনিতেই দেশীয় সবুজ পাখি ভীষণ ভালোবাসি, দেখে অনুমান করলাম সম্ভবত পাখিটি সুইচোরা। কিন্তু ঢাকা শহরে তাও আবার তেজগাঁওয়ে এই পাখি দেখবো ভাবিনি। গুলশান-নিকেতনের কাছে বিশাল সব ভবনের মাঝে এতটুকু সবুজ গাছগাছালিতে উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের এই পাখি দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
কাজ করি প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রকৃতিবার্তা অনলাইনে, পেশা বলেন আর প্যাশন, এমন পাখির দেখা পেলে লোভ সামলানো দায়। ডাইনিং রুমে ডেকে নিলাম অফিসের চিত্রগ্রাহক গোলাম মর্তুজা ভাইকে, বললাম টেলিলেন্সটা নিয়ে আসেন ভাই, ছবি তোলার জন্য অপেক্ষায় আছে সুদর্শন সুইচোরা।
কসরত করে জানালাটা খুলে শুরু হয়ে গেল সুন্দর পাখির ফটোশুট। শুরুতে কেবল একটি সুইচোরা দেখা গেলেও টেলিলেন্স এনে কড়ই গাছের দিকে ফেরাতেই দেখা গেল সেখানে দুই জোড়া সুইচোরা। মাঝে মাঝেই তাড়া ফুড়ুৎ করে উড়ছে, ডাইভ দিচ্ছে। পতঙ্গভুক পাখিগুলো ব্যস্ত শিকারে।
কিছুক্ষণ পর আমাদের সুবিধা করে দিতেই হোক অথবা ফটোজেনিক সৌন্দর্য্য মানুষকে দেখাতেই কিনা জানি না, একজোড়া সুইচোরা এসে বসলো জানালার আরও কাছে এক পুরনো ভবনের ছাদের আরেকটি পাতাশূন্য ডালে। সম্ভবত নিজেই সবুজ হওয়ায় এই পাখিরা পাতাশূন্য ডালেই বেশি বসে কিনা কে জানে! তবে সৌন্দর্যবোধ আছে বলতেই হয়।
এবার ছোট্ট করে এই পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক। সুইচোরার আরেক নাম সবুজ বাঁশপাতি। আকারে ছোট এই পাখির ইংরেজি নাম- Green Bee-eater; বৈজ্ঞানিক নাম- Merops Orientalis। অঞ্চলভেদে এর নাম ভিন্ন। কোনো স্থানে ‘নরুন চেরা’ নামেও পরিচিত। এরা পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে। বাঁশপাতি পতঙ্গ ধরার কৌশল বেশ চমকপ্রদ। উড়ে গিয়ে খপ করে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গিলে ফেলে। লোকালয়ের কাছাকাছি বৈদ্যুতিক তারে ও বাঁশের কঞ্চিতে বসে থাকতে এদের দেখা যায়। পাতাশূন্য ডাল এদের পছন্দ।
সবুজ বাঁশপাতির গড়ন ছিপছিপে। এর গায়ের রং উজ্জ্বল সবুজ। এর মস্তক ও পৃষ্ঠদেশের উপরাংশে রয়েছে সোনালি রংয়ের পালক। উজ্জ্বল তামাটে রংয়ের ডানার নিম্নভাগ দেখতে দারুণ। সবুজ বাঁশপাতি কৃষ্ণবর্ণ চঞ্চুটি একটু বাঁকানো। চোখের দুপাশে কাজলরেখা, যা ঘাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে। চিবুক ও গলায় রয়েছে নীল ছটা আর গলার নিচে রয়েছে মালার মতো কালো টান। এরা নদীর তীরে খাড়া জায়গায় গর্ত করে বাসা বানায়। শীতের শেষে প্রজনন মৌসুমে গর্তের গভীরে স্ত্রী পাখিটি ৫টি থেকে ৭টি সাদা রংয়ের ডিম পাড়ে।
অপরূপ এই ছিপছিপে গড়নের দেশী পাখি কোনো অংশেই সৌখিনদের পোষা বাজরিগারদের তুলনায় কম নয়। বরং মুক্তি পরিবেশে সূচালো লেজের সুইচোরাকে ঢাকা শহরে দেখা সত্যিই অন্যরকম আনন্দের। তাও আবার শিকাররত অবস্থায়!
চিত্রগ্রাহক: গোলাম মর্তুজা, ছবি স্বত্ব- প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।