বাগান করা অনেকেরই শখের কাজ। বাগান সাজাতে সবাই প্রধানত ফুল, ফল বা সবজির গাছ লাগিয়ে থাকে, কিন্তু অসুখ সারানোর ক্ষেত্রেও গাছের রয়েছে অসাধারণ ক্ষমতা। মানবজীবনে গাছ গাছড়ার চিকিৎসা সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।
বিশ্বে প্রায় ৫০ হাজারের মতন ঔষধি গাছ রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেই প্রায় ১ হাজার ৫শ প্রজাতির ঔষধি গাছ রয়েছে বলে জানা যায়। এর ভেতর এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ গাছের ঔষধি ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেছে। তুলসী, আমলকী, হরীতকী, বহেরা, নিম, নিসিন্দা, বাসক, অ্যালোভেরা, থানকুনি, শেফালি, জবা, পুদিনা প্রভৃতি, উদ্ভিদ মানুষ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করে আসছে।
এই লেখায় আমরা এমন কিছু উদ্ভিদ সম্পর্কে জানবো যা খুব সহজেই বাসার বারান্দায় কিংবা ছাদে লাগানো যায়। এসব উদ্ভিদ একদিকে যেমন ঘরোয়া চিকিৎসায় কাজে দিবে ঠিক তেমনি শহরের ইট-পাথরের ইমারতে আনবে সজীবতা।

পুদিনার ভেষজ গুণ
ভেষজ গুণের কথা এলেই প্রথমে আসবে পুদিনা পাতার কথা। দেখতে খুবই সুন্দর এই গাছের জন্য খুব একটা যত্নের প্রয়োজন হয় না। সময় মতো পানি দিলেই গাছ ভালো থাকে।
পুদিনা পাতায় ভিটামিন এ, সি আর বি-কমপ্লেক্স আছে, যা ত্বকের যত্নে আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আমাদের রোজকার জীবনে পুদিনার ব্যবহার-
- পুদিনায় থাকা রোজমেরিক এসিড হাঁপানি দূর করতে সাহায্য করে।
- স্তন, লিভার, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার রোধ করে।
- পেটের সমস্যা উপশমে দারুণ কার্যকরী। হজমে সহায়ক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট প্রচুর পরিমানে থাকার ফলে হজমের জন্য উপকারী “এনজাইম” তৈরি করে থাকে।
- এতে থাকা “এসেন্সিয়াল অয়েল” এর রয়েছে জীবাণু নাশক ক্ষমতা।
- আয়রণ, পটাসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ এই খনিজ উপাদানগুলো রক্তে ‘হিমোগ্লোবিন’ এর মাত্রা বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা অটুট রাখে।

থানকুনি গাছের গুনাগুন
আকারে ছোট হওয়ায় খুব সহজেই থানকুনি পাতার গাছ বাসার বারান্দায় কিংবা ছাদে লাগাতে পারবেন। থানকুনিপাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিইনফ্লামেটরি (প্রদাহরোধী) উপাদান। থানকুনি পাতায় ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় পাশাপাশি কোলাজেনের উৎপাদন বাড়ে। কোলাজেন ত্বকের বলিরেখা রোধ করতে এবং নমনীয়তা বাড়াতে কাজ করে।
তবে অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদের সাথে এর খাওয়ার পদ্ধতিতে কিছুটা ফারাক আছে। আপনি রস করে এবং চিবিয়ে তো খেতে পারবেনই, এর সাথে সাথে থানকুনি পাতা দিয়ে তৈরি করতে পারেন সুস্বাদু বড়া। এই লতানো উদ্ভিদের কান্ডও খাওয়া যায়। এর থেকে আপনি যে যে উপকার পেতে পারেন তা হলো –
- পেটের আলসার নিরাময়ে থানকুনি পাতা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
- আমাশয়ের চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয় এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ দূর করে।
- প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি থাকার ফলে এটি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- হজম শক্তি বাড়ায় একই সাথে লিভার ভালো রাখে।
- শরীরের ক্ষত এবং ঘা সারাতে সাহায্য করে।
- ব্রণের দাগ দূর করে।
- গলা ব্যথার জন্য উপকারি।

তুলসী গাছের গুনাগুন
তুলসী অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ঔষধি গাছ। উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তুলসীর ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে তুলসীর বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে।
সর্দি-কাশির সমস্যায় অনেক বেশি উপকারী তুলসী পাতা। তুলসী পাতা বেটে রস করে খাওয়া কিংবা সকাল বেলা মধুর সাথে কাঁচা পাতা চিবিয়ে খাওয়া – উভয় পদ্ধতিই অত্যন্ত কার্যকর। এতে রয়েছে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য। যা মুখের বিভিন্ন সংক্রমণে খুব ভালো কাজ দেয়।
তুলসী একটি চিরহরিৎ গুল্ম। এটি সর্বোচ্চ ২ ফুট উঁচু হয়। সুতরাং, আপনি খুব সহজেই এটি আপনার বাসার বারান্দায় বা ছাদে লাগাতে পারবেন।
প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেই শেষ নয়, আধুনিক বাজার অর্থনীতিতেও তুলসীর নানান ডাইভার্সিফাইড পণ্য যেমন চা, টুথপেস্ট, চুইংগাম, ইত্যাদি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে শুধু এর ভেষজ গুণাবলি’র কারণে। এবার দেখা যাক তুলসীর ব্যবহারগুলো –
- সর্দি-কাশিতে তুলসী পাতার রস এবং মধুর মিশ্রণ অত্যন্ত উপকারী। তুলসীর রস ফুটিয়ে গড়গড়া করলে গলা ব্যথা কমে।
- তুলসী চা মাথাব্যথায় কার্যকরী ফল দেয়।
- শরীরের কোথাও যদি কেটে যায় সেখানেও তুলসীর পাতা রক্তপাত বন্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়
- বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, তুলসী ফুসফুসের সমস্যা, ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি রোগে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
- তুলসী পাতার রস রক্তের সুগার ও কোলেস্টরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
- তুলসীর পানি দিয়ে গার্গল করলে মাড়ি সুস্থ থাকে এবং নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধের সমস্যা অনেকটাই কমে।
- স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধেও তুলসীর ভূমিকা অপরিসীম।

অ্যালোভেরা গাছের উপকারিতা
রূপচর্চা থেকে শুরু করে চিকিৎসা – অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী দ্বারা হয় না এমন কাজ নেই। বাসার টবে একটি অ্যালোভেরা গাছ থাকা মানেই আপনি সময়ে অসময়ে তা ব্যবহার করতে পারেন। এর পাতার ভেতরে লালার মতন পিচ্ছিল শাঁস অংশটিই আসলে রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অ্যালোভেরায় অন্তত ২০ রকমের খনিজ পদার্থ রয়েছে। মানবদেহের জন্য যে ২২টি অ্যামিনো এসিড প্রয়োজন এতে সেগুলো বিদ্যমান।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক অ্যালোভেরা গাছে কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের উপকার করছে।
- অ্যালোভেরা শরীরের কোলেস্টরলের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। রক্তে অক্সিজেন চলাচল বৃদ্ধি করে।
- অ্যালোভেরার জুস দাঁত ও মাড়ির ব্যথা কমায়। মুখের ইনফেকশন সারাতেও এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- অ্যালোভেরা জুসের এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরের মেদ কমাতে সাহায্য করে।
- অ্যালোভেরা মানুষের অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে দিয়ে হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি ডায়রিয়ার বিরুদ্ধেও কার্যকর।
- অ্যালোভেরা ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। এটি ব্রণ দূর করতে সহায়ক।
- অ্যালোভেরার জুস নিয়মিত পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।

বাসকের ঔষধি গুনাগুণ
বাসা বাড়ির বাগানের গাছ হিসেবে কিছুটা অপরিচিত হলেও বাসক পাতা কাশির বা কফের জন্য খুবই উপকারী একটি উদ্ভিদ। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ার ফলে দেখা যায় অধিকাংশ মানুষই এই কাশির সমস্যায় ভুগে। তাই আপনার বাসার বারান্দায় একটি বাসক গাছ থাকা মানেই প্রাকৃতিকভাবেই আপনার কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া। দেখে নেয়া যাক বাসকের কিছু উপকারিতা:
- বাসক শ্লেষ্মা বা কফ সারাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- হাঁপানি ও শ্বাসজনিত রোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়।
- খোস ,দাদপাঁচড়া সারাতেও এটি ব্যবহৃত হয়।
- উকুননাশক হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

গাঁদার ভেষজ গুণ
গাঁদা ফুলের গাছ একদিকে যেমন আপনার বারান্দার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে ঠিক তেমনভাবেই এর ঔষধি গুণও আপনাক অনেক রোগ সারাতে সাহায্য করবে। বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে ও ত্বকের জন্য হলেও গাঁদা ফুল গাছ রাখতে পারেন। চলুন দেখে নেয়া যাক গাঁদাফুলের ভেষজ কিছু গুণাগুণ –
- এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- গাঁদা ফুলের পাতা কোথাও পিষে লাগালে ক্ষত ভাল হয় এবং রক্ত পড়া বন্ধ হয়।
- এছাড়া হাড়ের ক্ষয় রোধ, আর্থ্রাইটিস ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতেও গাঁদাফুল সাহায্য করে।

পাথরকুচি পাতার উপকারিতা
অদ্ভুত এই উদ্ভিদটি পাতা থেকে জন্ম নেয়, আর এর ভেষজগুণ অনেক। খুব সহজেই আপনি এটি টবে লাগাতে পারেন। পাথরকুচির সবচাইতে বড় সুবিধার দিক হচ্ছে এই গাছটি লাগানোর জন্য আপনাকে বেশি অর্থ কিংবা জায়গা খরচ করতে হচ্ছে না। এছাড়া এর ঔষধি গুণের সুবিধা তো পাচ্ছেনই। পাথরকুচির কিছু উপকারি গুণ দেখা যাকঃ-
- কলেরা, ডায়রিয়া বা রক্ত আমাশয় সারাতে এটি খুবই কার্যকরী।
- সর্দিতে পাথরকুচির রস গরম করে খেলে তা ভাল কাজ করে।
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং মূত্রথলির সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেও পাথরকুচি ব্যবহার করা হয়।
- ত্বকের এলার্জি সারাতে পাথরকুচি ব্যবহৃত হয়।

জবার উপকারিতা
ফুল হিসেবে জবা খুবই জনপ্রিয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এর আলাদা ধর্মীয় তাৎপর্যও রয়েছে। তবে শুধু ফুল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার মধ্যেই জবার সকল তাৎপর্য শেষ হয়ে যায় না। এর ঔষধি গুরুত্বও অপরিসীম। এরকম বিশেষ গুণের অধিকারী উদ্ভিদ তো আপনার বারান্দায় কিংবা ছাদে জায়গা পেতেই পারে। দেখে নেয়া যাক, জবার উপকারিতা –
- চর্মরোগ কিংবা হাতের তালুর ছাল ওঠার প্রতিকার হিসেবে জবাফুল ঘষে ব্যবহার করা হয়।
- ত্বকের যত্নে জবা ফুল বেশ কার্যকর।
- বমি বমি ভাব দূর করতে জবা ফুলের শরবত খেতে পারেন।
বাড়ির বারান্দায় কিছু এমন কিছু গাছ লাগালে যেমন বারান্দার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায় তেমনি তার ফুল, মূল, পাতা, ফল, প্রভৃতি থেকে আমরা সাধারণ কিছু রোগের হাত থেকে প্রতিকারও পেতে পারি।
ডেস্ক রিপোর্ট 



















