প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের শীতবস্ত্র বিতরণ ও মেডিকেল ক্যাম্প

কুড়িগ্রামের দুর্গম চরে প্রকৃতি ও জীবনের উষ্ণতার হাসি   

  • নাসিমুল শুভ
  • আপডেট সময় ০৬:১৬:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 145

কুড়িগ্রামের দুর্গম চরে প্রকৃতি ও জীবনের শীতবস্ত্রে উষ্ণতার হাসি   

ভোর হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র পাড়ে নুনখাওয়া ঘাটের কুয়াশা কেটে যাচ্ছে সূর্যের উষ্ণতায়। ঘাটের রাস্তার শেষ সীমায় দাঁড় করানো ট্রাক থেকে নৌকায় বোঝাই হচ্ছে দশ বস্তা ‘উষ্ণতা’! কারণ বস্তাগুলোয় আছে চর নারায়ণপুরের মানুষের জন্য প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের দেয়া শীতবস্ত্র।

বস্তা ওঠানো শেষে চরের মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে নৌকায় উঠলেন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা। তাদের হাতে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রয়োজনীয় সব জরুরী ওষুধের বাক্স।

চিকিৎসাসেবা-শীতবস্ত্রের মাধ্যমে উত্তরে উষ্ণতা দেয়ার এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব এবং প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র।  এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল নারায়ণপুরে উষ্ণতা ছড়াতে ঘাট থেকে ছাড়লো নৌকা।

 ৩ ঘণ্টার নৌযাত্রা শেষে উষ্ণতার নৌকা ভিড়লো মিরকামারি ঘাটে। নদী ভাঙনে ঘাটের চেহারাই বদলে গেছে, সেখানেই কোনমতে  দাঁড়ানো দু’টি ঘোড়ার গাড়িতে ওঠানো হলো শীতবস্ত্রের বস্তা আর ওষুধের বাক্সগুলো।

চিকিৎসা সেবাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবকরা চেপে বসলেন ঘাটে অপেক্ষারত মোটরসাইকেলগুলোতে।

নদীর ভাঙা তীর ঘেঁষে, কখনো সরিষা খেত, কখনো আবার কারও বাড়ির উঠান চিড়ে যাওয়া মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো ঘোড়ার গাড়ি-মোটরসাইকেলের বিচিত্র বহর।

সকাল তখন প্রায় এগারোটা, বহরটি পৌঁছে গেল মধ্য নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ততোক্ষণে চরবাসী জোড়ো হয়েছেন স্কুলের বালুময় মাঠে। স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হয়ে গেলেন চিকিৎসা সেবা ও শীতবস্ত্র নিতে আসা চরবাসীকে লাইনে দাঁড় করাতে।

চিকিৎসা সেবা ও শীতবস্ত্রের জন্য দেয়া সাদা ও হলুদ কাগজের টোকেন হাতে একে একে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বসানো অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসাসেবীদের টেবিলের সামনে আসতে লাগলেন বাতের ব্যথা, জ্বর-সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে রক্তচাপের জটিলতা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যায় ভোগা রোগীরা।

সময় নিয়ে তাদের সমস্যাগুলো শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন চিকিৎসকরা, এই ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে পাশেই আরেক বুথ থেকে বিনামূল্যের ওষুধগুলো বুঝে নিতে লাগলেন শিশু থেকে বৃদ্ধরা।

অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পেয়ে স্বস্তির হাসি জয়তনের মুখে। তিনি প্রকৃতিবার্তাকে বলেন, ‘হামার কোমর ব্যথা, হাত-পা কিড়মিড়ায়, ব্যাটারা ওষুধ দিলেন, অ্যানা হামার চলতি পাবার বল হবি। কম্বল পালাম জারে (শীতে) আরাম হবি, আপনাগো দোয়া করি।’

বৃদ্ধ আজগর আলী ওষুধ পেয়েছেন কিন্তু কখন কিভাবে খাবেন তা বুঝে নিলেন এক চিকিৎসা সেবাকর্মীর কাছ থেকে। প্রকৃতিবার্তার প্রতিনিধি তার দিকে গেলে সরল হাসি হেসে বললেন, ‘ওষোদ বুঝে নিলাম’, কী সমস্যা আপনার জিজ্ঞেস করতে জানালেন, ‘সব্ব শইলে ব্যতা (পুরো শরীরে ব্যথা), উপর থেকে নিচ পর্যন্ত, এই সমস্যায় ডাক্তার দেখালাম ওষোদ দিলো।’

তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে স্কুল মাঠে রাখা একটি বেঞ্চে বসেছিলেন ইসমেত আরা। কোনো টোকেন পাননি, হয়তো ভিড়ে সন্তানদের নিয়ে হুড়োহুড়ি করে টোকেন নিতেই পারেননি।

প্রকৃতিবার্তার প্রতিবেদক ছবি তুলতে তাদের কাছাকাছি যেতেই অনুরোধ করলেন একটা হলেও যেন কম্বল তাকে যোগাড় করে দেয়া হয়। তার স্বামী নাই, গ্রামে হাত পেতে খেয়ে বেঁচে আছেন, থাকেন ভাইয়ের বাড়িতে।তার কথা প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের কর্মীদের কানে পৌঁছাতেই ইসমেত আরার হাতেও তুলে দেয়া হয় শীতবস্ত্র, এই অসহায় জননী ও তার তিন সন্তানের মুখে ফোটে মায়াভরা হাসি।

কুড়িগ্রামের এই চরে গত ২৭ ডিসেম্বর দিনব্যাপী চলে মেডিকেল ক্যাম্প ও শীতবস্ত্র বিতরণ। কয়েকশ মানুষকে দেয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা ও বিনামূল্যের ওষুধ এবং ৫০০ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়।

এভাবে প্রতিবছরই শীতে দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে সাধ্যমতো উষ্ণতা নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব। আর বছরজুড়েই দেশের প্রান্তিক জনপদের মানুষের জন্য নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করছে প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। কুড়িগ্রামের নারায়ণপুর চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান আয়োজকরা।

আপলোডকারীর তথ্য

Shuvo

চবি’র কলোনি থেকে ৯ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার  

প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের শীতবস্ত্র বিতরণ ও মেডিকেল ক্যাম্প

কুড়িগ্রামের দুর্গম চরে প্রকৃতি ও জীবনের উষ্ণতার হাসি   

আপডেট সময় ০৬:১৬:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

ভোর হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র পাড়ে নুনখাওয়া ঘাটের কুয়াশা কেটে যাচ্ছে সূর্যের উষ্ণতায়। ঘাটের রাস্তার শেষ সীমায় দাঁড় করানো ট্রাক থেকে নৌকায় বোঝাই হচ্ছে দশ বস্তা ‘উষ্ণতা’! কারণ বস্তাগুলোয় আছে চর নারায়ণপুরের মানুষের জন্য প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের দেয়া শীতবস্ত্র।

বস্তা ওঠানো শেষে চরের মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে নৌকায় উঠলেন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা। তাদের হাতে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রয়োজনীয় সব জরুরী ওষুধের বাক্স।

চিকিৎসাসেবা-শীতবস্ত্রের মাধ্যমে উত্তরে উষ্ণতা দেয়ার এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব এবং প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র।  এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল নারায়ণপুরে উষ্ণতা ছড়াতে ঘাট থেকে ছাড়লো নৌকা।

 ৩ ঘণ্টার নৌযাত্রা শেষে উষ্ণতার নৌকা ভিড়লো মিরকামারি ঘাটে। নদী ভাঙনে ঘাটের চেহারাই বদলে গেছে, সেখানেই কোনমতে  দাঁড়ানো দু’টি ঘোড়ার গাড়িতে ওঠানো হলো শীতবস্ত্রের বস্তা আর ওষুধের বাক্সগুলো।

চিকিৎসা সেবাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবকরা চেপে বসলেন ঘাটে অপেক্ষারত মোটরসাইকেলগুলোতে।

নদীর ভাঙা তীর ঘেঁষে, কখনো সরিষা খেত, কখনো আবার কারও বাড়ির উঠান চিড়ে যাওয়া মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো ঘোড়ার গাড়ি-মোটরসাইকেলের বিচিত্র বহর।

সকাল তখন প্রায় এগারোটা, বহরটি পৌঁছে গেল মধ্য নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ততোক্ষণে চরবাসী জোড়ো হয়েছেন স্কুলের বালুময় মাঠে। স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হয়ে গেলেন চিকিৎসা সেবা ও শীতবস্ত্র নিতে আসা চরবাসীকে লাইনে দাঁড় করাতে।

চিকিৎসা সেবা ও শীতবস্ত্রের জন্য দেয়া সাদা ও হলুদ কাগজের টোকেন হাতে একে একে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বসানো অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসাসেবীদের টেবিলের সামনে আসতে লাগলেন বাতের ব্যথা, জ্বর-সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে রক্তচাপের জটিলতা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যায় ভোগা রোগীরা।

সময় নিয়ে তাদের সমস্যাগুলো শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন চিকিৎসকরা, এই ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে পাশেই আরেক বুথ থেকে বিনামূল্যের ওষুধগুলো বুঝে নিতে লাগলেন শিশু থেকে বৃদ্ধরা।

অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পেয়ে স্বস্তির হাসি জয়তনের মুখে। তিনি প্রকৃতিবার্তাকে বলেন, ‘হামার কোমর ব্যথা, হাত-পা কিড়মিড়ায়, ব্যাটারা ওষুধ দিলেন, অ্যানা হামার চলতি পাবার বল হবি। কম্বল পালাম জারে (শীতে) আরাম হবি, আপনাগো দোয়া করি।’

বৃদ্ধ আজগর আলী ওষুধ পেয়েছেন কিন্তু কখন কিভাবে খাবেন তা বুঝে নিলেন এক চিকিৎসা সেবাকর্মীর কাছ থেকে। প্রকৃতিবার্তার প্রতিনিধি তার দিকে গেলে সরল হাসি হেসে বললেন, ‘ওষোদ বুঝে নিলাম’, কী সমস্যা আপনার জিজ্ঞেস করতে জানালেন, ‘সব্ব শইলে ব্যতা (পুরো শরীরে ব্যথা), উপর থেকে নিচ পর্যন্ত, এই সমস্যায় ডাক্তার দেখালাম ওষোদ দিলো।’

তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে স্কুল মাঠে রাখা একটি বেঞ্চে বসেছিলেন ইসমেত আরা। কোনো টোকেন পাননি, হয়তো ভিড়ে সন্তানদের নিয়ে হুড়োহুড়ি করে টোকেন নিতেই পারেননি।

প্রকৃতিবার্তার প্রতিবেদক ছবি তুলতে তাদের কাছাকাছি যেতেই অনুরোধ করলেন একটা হলেও যেন কম্বল তাকে যোগাড় করে দেয়া হয়। তার স্বামী নাই, গ্রামে হাত পেতে খেয়ে বেঁচে আছেন, থাকেন ভাইয়ের বাড়িতে।তার কথা প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের কর্মীদের কানে পৌঁছাতেই ইসমেত আরার হাতেও তুলে দেয়া হয় শীতবস্ত্র, এই অসহায় জননী ও তার তিন সন্তানের মুখে ফোটে মায়াভরা হাসি।

কুড়িগ্রামের এই চরে গত ২৭ ডিসেম্বর দিনব্যাপী চলে মেডিকেল ক্যাম্প ও শীতবস্ত্র বিতরণ। কয়েকশ মানুষকে দেয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা ও বিনামূল্যের ওষুধ এবং ৫০০ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়।

এভাবে প্রতিবছরই শীতে দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে সাধ্যমতো উষ্ণতা নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব। আর বছরজুড়েই দেশের প্রান্তিক জনপদের মানুষের জন্য নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করছে প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। কুড়িগ্রামের নারায়ণপুর চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান আয়োজকরা।