মাইক্রোসফট কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে এক বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্প্রতি তারা একটি নতুন ধরনের কোয়ান্টাম চিপ তৈরি করেছে, যার নাম ‘মেজোরানা ১’। এই চিপটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা ১০ লাখ টপোলজিক্যাল কিউবিট ধারণ করতে সক্ষম। গবেষকরা আশা করছেন, এটি আগামী দিনে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কার্যকারিতা আরও শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য করে তুলবে।
মাইক্রোসফট কয়েক বছর আগে থেকেই এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তারা মেজোরানা কোয়াসিপার্টিকলস (Majorana Quasiparticles) ব্যবহার করে টপোলজিক্যাল কিউবিট (Topological Qubit) তৈরি করার পথে এগোয়। এই কিউবিটগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো আকারে ছোট এবং প্রকৃতিগতভাবে স্থিতিশীল। সাধারণত, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। কারণ, প্রথাগত কিউবিট খুবই সংবেদনশীল এবং সামান্য পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। তবে মাইক্রোসফটের নতুন চিপ এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তি এমন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে, যা পারমাণবিক ফিউশন থেকে শুরু করে জটিল অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ, ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তবে এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন এখনো পর্যন্ত সহজ নয়, কারণ স্থিতিশীল কিউবিট তৈরি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকৌশলীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন কিভাবে কিউবিটগুলোর ত্রুটি কমিয়ে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করা যায়।
মাইক্রোসফটের মেজোরানা ১ চিপ এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এটি বিদ্যমান এক হাজার কিউবিটের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রচলিত কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহৃত কিউবিটগুলোর তুলনায়, মাইক্রোসফট সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। তারা এমন একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছে, যা টপোলজিক্যাল কিউবিট উৎপাদন করতে সক্ষম। তাত্ত্বিকভাবে এই নতুন ধরনের চিপ আরও স্থিতিশীল এবং মাপযোগ্য।
মেজোরানা কোয়াসিপার্টিকল, যা এই প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি, আসলে কোনো সাধারণ কণা নয়। এটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উদ্ভূত হয় এবং বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। এই প্রযুক্তি ভিত্তিক কাঠামোকে মাইক্রোসফট ‘টপোকন্ডাক্টরস’ নামে অভিহিত করেছে। এই উদ্ভাবনের পেছনে যে গবেষণা রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম প্রখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণাপত্রে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
মাইক্রোসফটের টেকনিক্যাল ফেলো ক্রিস্টা সোভোর এই চিপের কার্যকারিতা নিয়ে বলেন, “আমরা এমন একটি চিপের নকশা করেছি, যা মেজোরানা কোয়াসিপার্টিকলসের উপস্থিতি পরিমাপ করতে সক্ষম এবং তা থেকে আমরা একটি টপোলজিক্যাল কিউবিট তৈরি করতে পারি। এই কিউবিটগুলোর আকার ছোট, এগুলো নির্ভরযোগ্য এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।” তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তি কিউবিটের স্থায়িত্বজনিত সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। যদিও এখনো পর্যন্ত মেজোরানা ১ শুধুমাত্র আটটি বিশেষ ধরনের কিউবিট ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত আকারে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাদের মতে, টপোলজিক্যাল কিউবিট নিয়ে এখনো কোনো বিশদ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং ব্যবহারিক সাফল্য নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এই সমালোচনার বিষয়ে মাইক্রোসফটের টেকনিক্যাল ফেলো চেতন নায়েক বলেন, এই চিপ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং যুগের সূচনা করতে পারে। যা আগে কয়েক দশক দূরে বলে মনে করা হতো, সেটি এখন এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, এই নতুন প্রযুক্তি কেবল একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং এটি এক নতুন বাস্তবতার দ্বার উন্মোচন করছে।
অতএব, মাইক্রোসফটের মেজোরানা ১ চিপ কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা করেছে। এটি যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে তা বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের জন্য এক যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনবে।