শুক্রবার ছুটির দিন, এর উপর শীত! কিন্তু এর মধ্যেই সকাল সকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড় । এখানেই বসেছে প্রতিবছরের নিয়মিত আয়োজন পাখিমেলার ২৩ তম আসর। পাখির কোলাহলে মুখরিত ক্যাম্পাসে এই জায়গাটুকু যেন পরিণত হয়েছে পাখিপ্রেমী সব বয়সী মানুষের মিলনমেলায়।
মিলনায়তনে ঢোকার রাস্তাটার মুখে সুদৃশ্য কিন্তু সহজসরল একটা তোরণ, তাতে ইয়াবড় এক মাছরাঙার কাটআউট, পাশেই জাহাঙ্গীরনগরে প্রায়ই ঝাঁক বেঁধে বেড়াতে আসা সবুজ-কবুতর হরিয়ালের আরেকটি অবয়ব।
এই তোরণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এক সারি স্টল, তাতে নানা জাতের পাখপাখালি আর পাখির বই, ছবি, গেমসহ নানা আয়োজন।
ছুটির দিন, তাই শীত উপেক্ষা করেই দর্শনার্থীরা ভিড় করেছিলেন পাখি মেলায়। শিশু থেকে উঠতি বয়সী, কৌতুহলী মানুষের আগ্রহ স্টলগুলো ঘিরে। বন বিভাগের স্টলে ছিল বিশাল এক রাজ ধনেশ, ময়ূর, পেঁচাসহ দেশী-বিদেশী নানা জাতের পাখির স্টাফ করা (বিশেষ উপায়ে সংরক্ষিত) দেহ।
এই স্টলের পাশেই পর্যায়ক্রমে আরণ্যক ফাউন্ডেশনের স্টল। সেখানে পাখি নিয়ে নানা আয়োজনের সঙ্গে রয়েছে পাজল, যাতে টুকরো টুকরো ছবি মিলিয়ে পাখির রূপ দিতে পারলেই আছে স্যুভেনির পুরস্কার। স্টলের ভেতরে রয়েছে ডার্টগেমের ব্যবস্থা। যেখানে নানা পাখির ছবির সঙ্গে রয়েছে শিকারির ছবি। ডার্ট ছুড়ে শিকারিকে নিশানা করতে পারলেই জুটছে পুরস্কার। এই গেমের বার্তা পরিষ্কার, পাখি শিকার নয় পাখি শিকারের অভ্যাসের বিনাশ।
প্রতিবছরের মতো পাখি মেলায় অংশ নেয় প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার পরিচিত নাম ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’। স্টলটি সাজানো দেশের বিরল এবং পরিযায়ী পাখিদের ছবিতে।
সামনেই প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত পাখি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নানা বই। ছিল কমিকবুক পেঁচার পাঁচালি।
মেলায় আসা অভিভাবকদের অনেকেই আগ্রহ নিয়ে এই কমিকবুক সন্তানের হাতে তুলে দেন। অনেকে আবার নিয়েছেন দেশের পাখি ও প্রাণীদের ছবি দেয়া বইগুলো। বোনকে নিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের স্টলে মনোযোগ দিয়ে কয়েকটি বই খুলে দেখছিলেন মারিয়া মাহিরী।
প্রকৃতিবার্তাকে তিনি বলেন, পাখিমেলা খুবই ভালো লাগে। আমি প্রতিবছরই আসার চেষ্টা করি। গতবছরও এসেছি, এবছর এলাম। আমার মনে হয় পাখিদের নিরাপদ জায়গা নিশ্চিত করার বিষয়টি সবার গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। পৃথিবীর প্রতি প্রত্যেকটি প্রাণীর অধিকার আছে, পাখিদেরও নিরাপদে বসবাসের অধিকার আছে। আমি আগে ৬টি মুনিয়া পাখি পুষতাম, সেগুলো ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এছাড়া বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর স্টল ছাড়াও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও ক্লাবগুলোর স্টলেও ছিল কৌতুহলী দর্শনার্থীর ভিড়।
দু’টি স্টলের বিপরীতে দেখা গেল ছবি তোলার ভিড়। পাখির কাটআউটের ফটোবুথ-ফ্রেমের মাঝে দাঁড়িয়ে পাখিমেলায় আসাটা স্মরণীয় করে রাখতে ব্যস্ত অনেকেই।
এই বুথের পাশেই ছোট্ট এক দর্শনার্থীকে দেখা গেলো পাখির ছবিতে হাত বুলিয়ে আদর করছে যেন। একটু দূরেই বাবা-মা ব্যস্ত পাখির সঙ্গে শিশুটির মায়াময় দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে।
এদিকে মেলা কেবল স্টলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মেলার আয়োজনের মধ্যে ছিল পাখি দেখার মিশন। দূরবীন, ক্যামেরা আর নোটরাখার কাগজ হাতে সবুজ ক্যাম্পাসের বন-বনানী,ঝিলপাড়ে ছিল বার্ডওয়াচারদের সাবধানী পদচারণা।
সকালে একদিকে যখন পাখি দেখা চলছিল অন্যদিকে জহির রায়হান মিলনায়তনে চলছিল পাখি আঁকার প্রতিযোগিতা। মনের রঙে ক্যানভাস রাঙিয়ে রাঙা পাখি আঁকায় ব্যস্ত ছিল শিশু-কিশোররা।
ক্ষুদে কয়েক দর্শনার্থী আবার ছবি আঁকতে বসে গেলেন স্টলের ভেতরেই। পাখি কেবল কাগজে আঁকলেই চলে? অনেককেই দেখা গেল পাখি আঁকিয়ে নিচ্ছেন গালে।
মেলায় ছিল দারুণ মজার পাপেট শো। পাখি নিয়ে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে এই আয়োজন করেছিল কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার। নানা পাখি আমাদের কী কাজে আসে গল্পে গল্পে সেগুলোই বলে গেল সুতোটার টানে আর কণ্ঠের মুন্সিয়ানায় পরিচালিত পাপেটরা।
এরকম নানা বর্ণিল আর আনন্দময় আয়োজনে শুক্রবার দিনব্যাপী চলে প্রকৃতির অলঙ্কার পাখি সংরক্ষণে সচেতনা বৃদ্ধির এই মেলা।২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পাখি মেলা শুরু করেছিলো ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’। ২০০৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। সহ-আয়োজক হিসেবে বরাবরই এই মেলার সঙ্গে আছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।