রুমমেটের এক বড় ভাই ব্রিটিশ রেড়ক্রসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে বরগুনায় চাকুরি করেন। নাম সরকার পাশা। তারই আমন্ত্রণে ৭ মার্চ ঢাকার টেকনিক্যাল মোড় থেকে ৮ টার সাকুরা পরিবহনে রওয়ানা দিলাম বরগুনায়। রাতভর বাস চলল। ৪টি ফেরি পার হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য কুয়াকাটা। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয় রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির দুটি ফিল্ড পরিদর্শন শেষ করে যাব কুয়াকাটা। যাত্রা শুরু হল পাশা ভাইয়ের মোটরসাইকেলে। বরগুনি সদর পাপ হয়ে আমতলী যেতে মাঝখানে পড়ল পায়রা নদী। পারাপারে ফেরি চললেও গাড়ি না থাকায় নৌকায় পার হতে হতে অনেকটা সময় লেগে গেল। পায়রা নদীর প্রবাহ, নদীকেন্দ্রিক স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা আমাকে মোহিত করল।
আমতলী পার হয়ে বাইক ছুটছে কলাপাড়ার দিকে। ছুটছে তো ছুটছেই। কলাপাড়া থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে কুয়াকাটা যেতে আরো ৩টি ফেরি পার হতে হলো। পাশা ভাই বিকল্প সড়কে কুয়াকাটা যাবার কথা বললেন। এই পথে শুধু বালিয়াতলী নদীর ফেরি পার হতে হয়। আমরা কলাপাড়া থেকে বাম দিকের নদী পাড় হয়ে মূল সড়ক ধওে এগিয়ে চললাম। যাত্রাপথে অনেক খাল-নালা চোখে পড়ল। খালের কোলঘেঁষে রয়েছে গোলপাতা, কেওড়াসহ ম্যানগ্রোভ বনের নানা প্রজাতির উদ্ভিদ।
এ অঞ্চল আমার কাছে নতুন। তাই চলার পথে থেমে থেমে ক্লিক…ক্লিক… করে ছবি তুলতে লাগলাম। চলতে চলতে উপক‚লঘেঁষা গ্রাম পশুরবুনিয়া ও বিবির হাওলায় এসে থামলাম। এখানে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্থানীয় প্রকল্প পরিদর্শন শেষে গেলাম সদ্য ঘোষিত পায়রা সমুদ্র বন্দর এলাকার রামনাবাদ নদী চ্যানেলের পাড়ে। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, এই চ্যানেল দিয়েই জাহাজ বন্দও জেটিতে ভিড়বে।
বন্দর উন্নয়নে চলছে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। নদী থেকে বেশকিছু খাল গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে এগুলোতে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়। একদিকে যেমন জেলেদের জীবনযাত্রা চোখে পড়ল অন্যদিকে চোখে পড়ল প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের দল বেঁধে স্কুলের যাওয়ার চিত্র। ভালো লাগল এই ভেবে যে, আমাদেও আগামী প্রজন্ম সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। নাওয়াপাড়ার আরেকটা প্রকল্প ঘুরে এবার সোজা কুয়াকাটার দিকে এগিয়ে চলল আমাদের বাইক। পথের দুপাশের পরিবেশ আর প্রকৃতি দেখে শুধু মুগ্ধ হবার পালা। পথের পাশে গোলপাতার বড় একটা বন দেখে নেমে ঘোরাঘুরির লোভটা সামলাতে পারলাম না। মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। ক্লিক…ক্লিক… করে বেশকিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর আবার ছুট। থেমে গেলাম বিজয়রামা বৌদ্ধ মন্দির দেখতে।
কথা হল অধ্যক্ষের সাথে। দেখা হলো পাশের রাখাইন পল্লী। শেষে আবার শুরু হল পথ চলা। আলীপুর বাজাওে পৌঁছে ভরপেটে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। তারপর কুয়াকাটা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত। খ্যাতি রয়েছে সাগর কন্যা হিসেবে। বরিশাল বিভাগের শেষ মাথায় পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সমুদ্রসৈকত। প্রথমেই আমরা দেখতে পেলাম ঐতিহাসিক কুয়া (কুপ), বৌদ্ধ মন্দির ও প্রাচীন নৌকা। তারপর সৈকতজুড়ে বাইকে কয়েকবার চক্কর দিলাম।
সৈকতের এক প্রান্ত দিয়ে আন্ধারমানিক অন্য প্রান্ত রামনাবাদ নদী সাগরে ঢুকেছে। প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে অনেকটা সময় পার করে দিলাম দু’ মোহনার পাশে। দেখা হয়ে গেল শত শ তলাল কাঁকড়ার সাথে। দূর থেকে এদের দেখলে লাল গালিচা বলে ভ্রম হতে পারে। তি দারুণ দেখতে এরা! কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, সৈকতের পাশ দিয়ে আলাদা কোনো রাস্তা না থাকায় শতশত মোটরসাইকেল চলছে সৈকতের উপর দিয়ে। চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল। স্থানীয় শুঁটকি পল্লীও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গন্ধটা ছাড়া সবই ভালো লাগল।
শেষে সাগরের সাথে আলিঙ্গন করতে নেমে পড়লাম জলে। তারপর জল নিয়ে খেলা। বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। মনের সব গ্লানি যেন ধুয়েমুছে গেল নীল সাগরের জলে। গোসল সেরে ঝাউ ও নারিকেল বনে বেশকিছুটা সময় কাটালাম। তারপর ঘুরে দেখলাম কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। কুয়াকাটাই দেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়।
রাতে ঢাকা ফেরার তাড়া থাকায় শেষ বিকালে সৈকত ছেড়ে আমতলীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিরছি আরেক দিকের পথ দিয়ে। এ পথে ৩টি নদী পার হতে হল। সৈকতের সূর্যাস্ত কিন্তু মিস করলাম না। সড়ক আর ফেরি শেষে আমতলীতে যখন এসে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে। পাশা ভাই আগেই আমার ফেরার টিকেট করে রেখেছিলেন। বাজারে জয়নালের দোকানে ভাত খেলাম। রেড়ক্রিসেন্ট সোসাইটির তালতলী এলাকার কর্মকর্তা রুহল আমিন লিটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পাশা ভাই বরগুনায় চলে গেলন। লিটন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে কাউন্টরে বাস এসে হাজির হল। পরবর্তীতে ফাতরার বন দেখতে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিদায় নিলাম লিটন ভাইয়ের কাছ থেকে। আমার চোখে মুখে হৃদয়ে গেঁেথ রইল কুয়াকাটার রক্তিম সূর্য আর জলরাশি। জলরাশির শব্দতরঙ্গ এখনো কানে বাজছে।
লেখক: পর্যটন ও ভ্রমণবিষয়ক