জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কেবল তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের স্বল্পোন্নতদেশগুলোতেই নানা পরিবর্তন আসছে এমনটা নয়। জলবায়ু পরিবর্তন ঘটানোর জন্য দায়ী ধনী দেশগুলোতেও এর প্রভাব প্রকট হতে শুরু করেছে। গরম বাড়তে থাকায় শীতপ্রধান দেশগুলোতে দেখা দিচ্ছে কিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন। যা আগে কেবল গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে দেখা যতো সেগুলো দেখা দিতে শুরু করেছে শীতের দেশগুলোতেও। বদলে যাওয়া জলবায়ুতে প্রকৃতির ইতিবাচক-নেতিবাচক পরিবর্তনের খবর আসছে। যেমন সেপ্টেম্বরে খবর প্রকাশিত হয়েছিলে যে, যুক্তরাজ্যে নাকি ধানের ফলন হয়েছে! অথচ এই শীত প্রধান দেশে কখনোই ধান চাষের আবহাওয়াই ছিল না। তবে সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছে, রেকর্ড উষ্ণ গ্রীষ্মের পর যুক্তরাজ্যে প্রথমবার ধান ফলেছে। এছাড়া রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রায় কখনো দেখা না যাওয়া মশা উড়ছে আইসল্যান্ডে!
জলবায়ু পরিবর্তনের অবদান, যুক্তরাজ্যে প্রথমবার ফলেছে ধান!
ক্যাম্ব্রিজশায়ারের ইলি থেকে কয়েক মাইল উত্তরে নতুন বানানো ধানক্ষেত থেকে দেশের প্রথম এ ফসল তোলা হয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ফিলিপিন্সসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ধানের ৯টি জাত নিয়ে শীতে সেগুলো রোপন করা হয়েছিল। ১৮৮৪ সালে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর এ বছরই সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মকাল দেখেছে যুক্তরাজ্য, আর এর মধ্যেই ধান গাছগুলো বেড়ে ওঠে।
গবেষকদলের প্রধান সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির (ইউকেসিইএইচ) নাদিন মিটসচুনাস জানান, তিনি যখন লোকজনকে বলতেন যে তিনি যুক্তরাজ্যে ধান ফলাচ্ছেন, তারা ভাবতো তিনি ঠাট্টা করছেন।

“কেউই আগে এটা চেষ্টা করে দেখেনি, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা এমন ফসল পেতে যাচ্ছি, যা হবে বলে ১০ বছর আগে কেউ ভাবেওনি। আগামী ১০ বছরের মধ্যেই ধান আমাদের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত ফসল হয়ে উঠতে পারে,” বলেছেন তিনি।
সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির অধ্যাপক রিচার্ড পাইওয়েল বলেছেন, ব্রিটেন এখন ধানের স্বাভাবিক আবহাওয়ার প্রান্তসীমায় রয়েছে। যে কারণে কৃষকদের জন্য এখনই ধানের বাণিজ্যিক চাষ শুরু ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
তবে গবেষণা বলছে, জলবায়ু যদি ক্রমাগত উষ্ণ হতে থাকে, তাহলে ইংল্যান্ডে বড় পরিসরেই ধান উৎপাদন সম্ভব।
আইসল্যান্ডে মশা! যা আগে দেখা যায়নি
গেল বসন্তে রেকর্ডভাঙা গরম দেখা আইসল্যান্ডে প্রথমবারের মতো মশার খোঁজ মিলেছে।
পতঙ্গপ্রেমী বিয়র্ন হিয়াল্টাসান জানান, মথ দেখার জন্য তিনি গত সপ্তাহে একাধিক রাতে ওয়াইনে ভেজানো দড়ি ব্যবহার করেছিলেন. ওই রাতগুলোতে তিনি মশার দেখা পান বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

হিয়াল্টাসন দুটি স্ত্রী মশা ও একটি পুরুষ মশার কথা বলেছেন, যেগুলো কিউলিসেটা অ্যানুলেটা প্রজাতির সদস্য বলে পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যে অল্প কয়েক প্রজাতির মশারা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়ও টিকে থাকতে পারে, তাদের মধ্যে কিউলিসেটা অ্যানুলেটা অন্যতম, জানিয়েছে বিবিসি।
এর আগ পর্যন্ত আইসল্যান্ড ছিল পৃথিবীর দুটি মশা-মুক্ত স্বর্গের একটি। অন্যটি হল অ্যান্টার্কটিকা। মূলত, ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণেই এই এলাকাগুলোতে মশা থাকতে পারে না।
আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিকের দক্ষিণ পশ্চিমের হিমবাহ উপত্যকা কিয়োসে এই মশাগুলো পাওয়া গেছে।
হিয়াল্টাসন তার আবিষ্কারের খবর স্থানীয় বণ্যপ্রাণী সংশ্লিষ্ট একটি ফেইসবুকে শেয়ার করে মশাগুলোর ছবিও দেন; সঙ্গে লেখেন, লাল ওয়াইনের ফিতায় অদ্ভূত এক পতঙ্গ’।
তার ওই পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে তা শেয়ার করেছে আইসল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম মরগুনব্লাদিথ। সেখানে তারা লেখে, “শেষ দূর্গেরও পতন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
হায়াল্টাসন পরে তার পাওয়া পোকাগুলোকে শনাক্তের জন্য আইসল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব নেচারাল হিস্টরিতে পাঠালে এই পতঙ্গগুলো যে মশা, তা নিশ্চিত করেন পতঙ্গবিদ মাথিয়াস আলফ্রেদসন।
মশার এই প্রজাতিটি ইউরোপের বিভিন্ন অংশ ও উত্তর আমেরিকায় প্রায়শই দেখা যায়; এটি ঠিক কীভাবে আইসল্যান্ডে পৌঁছেছে তা স্পষ্ট নয়, সিএনএনকে বলেছেন আলফ্রেদসন।
আইসল্যান্ডের ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থির জলাশয় না থাকায় দেশটিতে এতদিন মশাদের উপস্থিতি ছিল না, বলছেন ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ।
কিন্তু এ বছর দেশটিতে এতটাই গরম পড়েছে যে তা আগের একাধিক রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আইসল্যান্ডের আবহাওয়া দপ্তর বলছে, আইসল্যান্ডে মে মাসে ২০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা খুব কম দেখা যেত, হলেও এই ধরনের তাপপ্রবাহ ২-৩ দিনের বেশি দীর্ঘায়িত হত না। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এ বছরের মে-তে দেশটির বিভিন্ন অংশে টানা ১০ দিন ২০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা দেখা গেছে। এবার তারা মে মাসে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ দিনও দেখেছে, সেদিন এগ্লিস্তাদির বিমানবন্দরের তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

তাপমাত্রার এমন পরিবর্তন আইসল্যান্ড ও এর আশপাজুড়ে ঠাণ্ডা আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রে ‘মারাত্মক’ প্রভাব ফেলবে বলে গ্লোবাল হিট হেলথ ইনফরমেশন নেটওয়ার্কে প্রকাশিত জুনের এক গবেষণায় ধারণা দেওয়া হয়েছে।
রেকর্ড বিবেচনায় গত বছর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র ও স্থলভাগের এ উষ্ণায়নের পেছনে মানুষের প্রভাবই ‘অপরিসীম’, বলছে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক কর্তৃপক্ষ।
মশা কী ‘আসলেই আইসল্যান্ডে আবাস গাড়তে পেরেছে কীনা’ তা নিশ্চিত হতে আসন্ন বসন্তে আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন আলফ্রেদসন।
প্রকৃতিবার্তা ডেস্ক 



















