বাংলাদেশে বজ্রপাত বাড়ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। গত বছরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ২৯৭ জন নিহত হয়। চলতি বছরও মৌসুমের শুরুতেই বজ্রপাতে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গত সপ্তাহের রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুরো এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৩০ জনের।

এই বাড়তে থাকা দুর্যোগটি নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে। এতে উঠেছে বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ, ক্রমে বাড়তে চলা এই দুর্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতির কথা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বজ্রপাতের পূর্বাভাসও দেয়া শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক জানান, ১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সতর্কতা দেয়া শুরু হয়েছে। এর আগে এই সক্ষমতা ছিল না।

তিনি বলেন, ‘আমরা দুই থেকে চার ঘণ্টা আগে এখন এই সতর্কতা দিতে পারি। আমরা উন্নত গাণিতিক মডেল, লাইটনিং ডিটেক্টর এবং জাপানের ইউমোরি স্যাটেলাইটের ডাটা বিশ্লেষণ করে অ্যালার্ট দিচ্ছি।’

তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন গড়ে প্রতিবছর ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। প্রচুর গবাদি পশুও মারা যায়। ২০১৬ সাল থেকে বজ্রপাতকে বাংলাদেশে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রমেঘের এলাকার পরিবর্তন ঘটেছে। এই উষ্ণায়নের কারণে নাইট্রোজেন বেশি নিতে পারছে মেঘ। নাইট্রোজেন যত বেশি নেবে, বজ্রপাত তত বাড়বে। উঁচু গাছপালা কেটে ফেলার কারণে এখানে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। আর একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনের কারণে অধিকাংশ সময় মাঠে থাকায় কৃষকরা এর শিকার হচ্ছেন বেশি। বজ্রপাত উঁচু জায়গায় আঘাত করে নিস্ক্রিয় হয়। মাঠে বা খোলা জায়গায় গাছপালা না থাকায় কৃষক, গবাদি পশু, পথচারিদের আঘাত করে।’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলেই ভবন বা ঘরে আশ্রয় নিতে হবে। খোলা জায়গা, ছাতা বা গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। আমাদের এখানে শহরের চেয়ে গ্রামে ক্ষয়-ক্ষতি অনেক বেশি। কারণ, শহরে উঁচু ভবন আছে। আর ভবনগুলোতে প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। কিন্তু গ্রামে ফাঁকা জায়গা, খোলা মাঠ, ফসলের মাঠ অনেক বেশি। সেখানে আর আগের উঁচু গাছ নাই। ফলে বজ্রপাতের সময় মাঠে থাকা কৃষক, গবাদি পশু, পথচারী এর শিকার হন।’

বাংলাদেশে বিগত সরকারের সময়ে বজ্রপাত নিরোধে সারাদেশে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন স্বল্প পরিসরে লাইটনিং অ্যারেস্টার লাগানো হয়েছে।

পরিবেশ ও বজ্রপাত বিষয়ক গবেষক এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড.ফেরদৌস আহমদে বলেন, ‘মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর , যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেক্সাস ও ফ্লোরিডায়ও অনেক বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। অষ্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায়ও বজ্রপাতের হার অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে তাদের ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষয়-ক্ষতি অনেক কম। এর কারণ হলো, ওরা আগেই পূর্বভাস দিতে পারে। ওই এলাকাগুলো আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নয়। আর লাইটনিং অ্যারেস্টার অনেক বেশি। তাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও অনেক এগিয়ে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারাদেশে অ্যারেস্টার বসানোর একটা প্রকল্প নিয়ে আমরা কাজ করছি। অ্যারেস্টার বসালে সেটা সব সময় মেনটেইন করতে হয়। এর সঙ্গে মন্ত্রণালায় ও দাতারা যুক্ত আছেন। তারা এর সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। তার পরে সিদ্ধান্ত হবে।’

এদিকে গবেষক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘ওই তালগাছ লাগানো হয়েছিল রাস্তার দুই পাশে। মাঠের মধ্যে লাগানো হয়নি। কিন্তু সেটা তো তেমন কাজে আসেনি। আর রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি। কারণ, বজ্রপাতে মাঠ ও খোলা জায়গায় যারা থাকেন, তারা এর শিকার হন। আর লাইটনিং অ্যারেস্টার যা বসানো হয়েছে, তা-ও অপরিকল্পিত। লাগানে হয়েছে জেলা প্রশাসকের অফিস ভবনের উপরে। সেখানে আবার ওয়্যারলেস টাওয়ার আছে। সেটা অ্যারেস্টারের চেয়ে উঁচু। তাহলেও ওটা কী কাজে আসবে? ওখানে তো অ্যারেস্টার প্রয়োজন নাই। আবার মাঠে যা দেয়া হয়েছে, তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।’

এই দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বজ্রপাত আগেও হয়েছে, মানুষ মারাও গেছে। এখন ক্ষতিপূরণ দেয়ার কারণে বেশি জানা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা বজ্রপাতের যে প্রাকৃতিক নিরোধক, তা নষ্ট করে ফেলেছি। মাঠের পাশে বাবলা গাছ, তাল গাছ কেটে ফেলেছি। রেইনট্রি গাছ নাই। ফলে মাঠে যখন বজ্রপাত হয়, তখন কিন্তু সেখানে মানুষ আর গবাদি পশু ছাড়া উঁচু কিছু পায় না।’

তিনি আরও বলেন,‘মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিতে বজ্রপাতেরও প্রয়োজন আছে। মাছের উৎপাদনের জন্য দরকার। মাছের ডিমের জন্য দরকার। কারখানায় নাইট্রোজেন লাগে। বজ্রপাত নাইট্রোজেন উৎপাদন করে।’