জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক ২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠান। প্রকৃতি সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক ২০২৩’ তুলে দেয়া হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো: মনজুরুল কিবরীয়ার হাতে। হালদা নদী রক্ষা ও মা মাছ এবং ডলফিন সংরক্ষণে ড. কিবরীয়ার পরম আন্তরিকতাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানানো হলো। পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের প্রতি আন্তরিক মানুষটির হাতে পদক তুলে দিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই বাৎসরিক আয়োজনের এটি ছিল ১৩ তম আসর। এ উপলক্ষ্যে আজ বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও শহীদ তাজউদ্দিন স্মরণীতে চ্যানেল আইয়ের “চেতনা চত্বর” সেজেছিল সবুজ গাছগাছালি এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণে তৈরি বাংলাদেশের মানচিত্রশোভিত মঞ্চে। লাল-সবুজ আলোর নাচন, সঙ্গীত-নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় এই জমকালো অনুষ্ঠান পরিণত হয়েছিল প্রকৃতিপ্রেমী এবং পরিবেশকর্মীদের মিলনমেলায়।
সন্ধ্যা তখন ৬টা বেজে ৩৫ মিনিট, প্রতিশ্রুত সময়েই চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে আসেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী গামছা গলায় পরিয়ে বরণ করে নেয় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন টিম। এরপরেই শুরু হয় মূল আনুষ্ঠানিকতা।
অনুষ্ঠানের শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে, এর আগেই আমন্ত্রিত অতিথিদের হাতে তুলে দেয়া হয় দেশের পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা হাতে আগতরা গলা মেলান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানে। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতির মায়াভরা এই গান শেষে প্রদর্শিত হয় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের কর্মযজ্ঞ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র।
তথ্যচিত্র শেষে মঞ্চে আসেন ফাউন্ডেশনের প্রাণপুরুষ মুকিত মজুমদার বাবু। অনুষ্ঠানে আগতদের বিজয় মাসের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রকৃতিবন্ধু বলেন,‘প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি। আমরা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি প্রকৃতি ভাল না থাকলে আমরা ভাল থাকবো না, আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে একথা এখন আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। পরিবেশকে অবহেলা করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ফলপ্রসূ হবে না।’ আগামী প্রজন্মের জন্য তাই পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান তিনি।
১৯৭১ সালে নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, ‘৫৩ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক দুর্যোগ হয়েছে। তবু আশা করেছি ভাল কিছু হবে। আজকে ৫৩ বছরে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি যেভাবে থাকার কথা ছিল তা রাখতে পারিনি। দেশে সাম্প্রতিক যে পরিবর্তন এসেছে সেই পরিবর্তনে আমরা ভাল কিছু আশা করছি। ভাল থাকতে হলে পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভাল রাখতে হবে। বাংলাদেশকে ভাল রাখতে হলে আমাদের সবার হাতকে এক করতে হবে।’
তার বক্তব্য শেষে মঞ্চে মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যশিল্পী নাঈম ও তাঁর দল। এরপর এবছর প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়ার ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তথ্যচিত্র শেষে সেই বিশেষ মুহূর্ত, ড. মনজুরুল কিবরীয়ার হাতে ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক ২০২৩’ তুলে দেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
একই সঙ্গে হালদারক্ষায় সদাতৎপর এই অধ্যাপকের হাতে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন ইমপ্রেস গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ মজুমদার এবং ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন।
পদক প্রাপ্তিতে অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া ২০০৯ হালদা নিয়ে করা সেমিনারে তখন পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন। বর্তমানের পরিবেশ উপদেষ্টাকে ‘পরিবেশ আপা’ সম্বোধন করে তার মাধ্যমে দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে নতুন আশা দেখছেন বলে জানান অধ্যাপক কিবরীয়া। দেশের প্রতি, প্রাণ-পরিবেশের প্রতি অবদান রেখে চলায় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং চ্যানেল আইয়ের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কিছু কিছু সন্ধ্যার গরিমাই হয় অন্যরকম। আজকের সন্ধ্যাটাও সেরকম। পরিবেশ নিয়ে আমরা যারা কাজ করি তারা সব সময়ই একধরনের শঙ্কা, ঝুঁকি, একধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকি। মাঝে মধ্যে কেউ যখন আমাদেরকে নিয়ে দু-একটা ভাল কথা বলে বা আমাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়, তখন মনে হয় যে কাজগুলো করে যাচ্ছি এগুলো কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও দেখছে। এই দেখাটাই, স্বীকৃতিটাই আমাদের একটা বড় পাওয়া।’
প্রায় ১৫ মিনিটের বক্তব্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হালদা রক্ষায় অধ্যাপক কিবরীয়ার অবদান উল্লেখ করার পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। পরিবেশ উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে কাজ করা এরকম মানুষদের নিয়ে এক হয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ, নদীরক্ষা ও পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যতটুকু সম্ভব করে যাবে সরকার।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য শেষে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের ১৬ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে কাটা হয় কেক। সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রকৃতি ও জীবন মিউজিক ক্লাবের শিল্পীরা। এরপর নৈশভোজের মাধ্যমে শেষ হয় পদক প্রদানের বর্ণাঢ্য আয়োজন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন চ্যানেল আইয়ের চেনা মুখ দীপ্তি চৌধুরী এবং সাফি আহমেদ।