বাংলাদেশকে যদি একটি দেহ হিসেবে কল্পনা করা হয় তবে নদ-নদী হলো এই দেহের ধমনী-শিরা-উপশিরা। অথচ সর্বগ্রাসী লোভ, অপরিণামদর্শী উন্নয়ন, নৌপথকে উপেক্ষা করার রীতির কারণে আজ বাংলাদেশের প্রাণরস বহনকারী নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে। এই বাস্তবতায় নদী দখল, দূষণ, নাব্যতা সংকট উত্তরণসহ ‘জীবিত সত্তা’ নদী রক্ষার জন্য কেবল বেসরকারি সংস্থার তৎপরতাই নয়, ব্যাপক জনসচেতনতা গড়া এবং তরুণদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা এখন সময়ের প্রয়োজন। পরিবেশকর্মী ও তারুণ্যের যৌথ প্রয়াসে হারিয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারসহ নদীর অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর নদীর প্রতি মায়া জাগাতে নদীর সংকট, সমস্যা এবং দেশের নদ-নদী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভে পড়াশোনা-গবেষণার বিকল্প নেই বলেও মতামত নদীজনদের।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস ২০২৫’ ও এ সংক্রান্ত রচনা প্রতিযোগীতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব বিষয়ে কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন এই দিবসের নামকরণের বিষয়টি স্পষ্ট করেন।

তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ অ্যাকশন ফর রিভার্স-এর বাংলা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। এই দিবসটি আসলে নদীর জন্য করণীয় সংক্রান্ত একটি বিশেষ দিন। যেমন বিশ্বের কিছু দেশে নদী থেকে কোনো বাঁধ, প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হলে তারা সেটিকে নদীর জন্য উদযাপন করে। আমাদের দেশেও তরুণদের মাঝে নদী ভাবনাটাকে জাগ্রত করে, নদীকে আপন করে নেয়ার সংস্কৃতিটা ছড়িয়ে দিতে এই আয়োজন।’
বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) নায়োকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রম।

তিনি বাংলাদেশের নদী নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘কর্মসূত্রে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কয়েকটি নদী ঘুরে দেখেছি। দুঃখের সঙ্গে বলছি, তুরাগ নদের আশপাশের কৃষক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা আমাদের বলছিল যে সেই নদের পানি কতটা দূষিত। এই নদের পানি কোনো কাজেই লাগে না এখন, এত বিষাক্ত যে সেচ দেয়া যায় না এমনকি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতেও ব্যবহারের অনুপযোগী। আসুন আমরা সবাই এই নদীগুলো রক্ষা করি, নদী রক্ষায় আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে, আসুন আমরা সবাই নদী রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।’
বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল এলাকাগুলোর নদী দূষণের বড় দায় বর্তায় ট্যানারি এবং গার্মেন্টস কারখানাগুলোর ওপর। নদীকৃত্য দিবসের আলোচনায় পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী দেন চমকে দেয়া এক তথ্য! তিনি বলেন, ‘এক কেজি ডেনিম প্যান্ট (জিন্সের প্যান্ট) তৈরির প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন ৬০ কেজি পানি লাগে! তাহলে কেবল ডেনিম কারখানাগুলোতেই কত পানি লাগে। অথচ পোশাক শিল্পের তরল বর্জ্যে নদী দূষণ বন্ধে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। কম খরচে কারখানা স্থাপনের কথা বলে কার্যকর বর্জ্য শোধনাগার ছাড়াই গড়ে তোলা হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পকারখানা। তরল বর্জ্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে প্রকৃতিতে, ফলে মাটি-পানি দূষিত হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কারখানাগুলো, তাদের বর্জ্যব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং তরুণ কর্মকর্তাদের আধুনিক প্রযুক্তি, পানির পুনর্ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে, সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। ধারণাগত ভুল-ত্রুটি দূর করতে হবে।’
দেশের নদী রক্ষার আন্দোলনে প্রথম আইনিপন্থায় এগিয়ে আসা সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। নদীকৃত্য দিবসের আলোচনায় অংশ নিয়ে বেলার হেড অব প্রোগ্রাম ফিরোজুল ইসলাম বলেন, ‘নদীতে কোনো অবকাঠামো গড়ার আগে সরকার যেন ভেবে-চিন্তে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যেন নদীপথের নাব্যতা থাকে, জলযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। যেহেতু আমরা বলছি নদী একটি জীবন্ত সত্তা, এই জীবন্ত সত্তাকে মেরে ফেলার অধিকার আমাদের নেই।’

আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসের আলোচনা ও রচনা প্রতিযোগীতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। নদী রক্ষা ও বিপন্ন নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দখল-দূষণ প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
নদীরক্ষায় দেশব্যাপী জাগরণ ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রকৃতিবন্ধু বলেন, ‘আমার শৈশবে যে নদীগুলো ছিল সুন্দর, স্বচ্ছ এবং স্রোতস্বিনী, সেগুলো এখন আমাদেরই কারণে কলুষিত হয়ে গেছে। যখন আমরা ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দিকে তাকাই তখনই বোঝা যায় যে আমরা আসলে কী করেছি! ঢাকার বাইরের নদীগুলোর অবস্থাও সুখকর নয়।’
প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সরব এই সবুজপ্রেমী মানুষটি আরও বলেন, ‘সব কিছু মিলিয়ে একটি কথা- নদী আমাদের প্রাণ, নদীকে বাঁচাতে হবে।’
আলোচনা পর্বে আরও অংশ নেন – বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন, বাংলাদেশ নদীপরিব্রাজক দলের উপদেষ্টা অধ্যাপক অসীম বিভাকর, বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. রাশেদুল করিম মুন্না, নদী পরিব্রাজকদলের সভাপতি অ্যাড. নুরুজ্জামান শিপন প্রমুখ।
আলোচনা পর্ব শেষে নদী ও নাব্যতা বিষয়ক রচনা প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে সার্টিফিকেট এবং প্রাইজ মানির চেক তুলে দেন অতিথিরা।
উল্লেখ্য, ১৪ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস। যাকে আরেক ভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু; এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমাদের নদী-আমাদের ভবিষ্যৎ’।