রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জনবহুল এলাকা থেকে গত চার মাসে তিনশো’র বেশি বিষধর সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। মানুষের বাসার ভেতরে, গ্যারেজে এমনকি বহুতল ভবনের নয়তলায়ও সাপ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে পদ্মগোখরা, রাসেল ভাইপার, খৈয়া গোখরা, রাজ কেউটের মতো বিষধর সাপও রয়েছে। ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় এ ধরণের বিষধর সাপ পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
কিন্তু ঢাকায় কংক্রিটের মাঝেও এত সাপ কেন, কেন এই সরীসৃপগুলো ভবনে উঠে আসছে এসব কারণ জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে: ঢাকার বনশ্রী, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, বসিলা, উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর, খিলগাঁও, কচুক্ষেত, মিরপুর-২, নিকেতন, উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণখান থেকে এখন পর্যন্ত বিষধর সাপগুলো উদ্ধার করা হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাপ পাওয়া গেছে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউকের ফ্ল্যাট প্রকল্প এলাকায়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বনশ্রী এলাকা। এর মধ্যে নতুন করে খিলগাঁও-এ গত এক সপ্তাহ ধরে সাপ বেশি দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আদনান আজাদ বলেন, ” উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজউকের যে ফ্ল্যাট ওখানে সবচেয়ে বেশি সাপ পেয়েছি। সাততলা, নয়তলা থেকে সাপ উদ্ধার করেছি। এখানকার ১১টা বিল্ডিং থেকে সাপ উদ্ধার করেছি।”
এতো উঁচু ভবনে কিভাবে সাপ গেলো এমন প্রশ্নে আজাদ ধারণা করেন, যেসব ভবনের উপরের ফ্ল্যাটে সাপ পাওয়া গেছে সেগুলোর প্রতিটি ভবনের গেইটের সাথে বাগান বিলাসের মতো লতানো গাছ রয়েছে, সেই গাছগুলো বেয়ে উপরে ওঠার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকেই হয়তো সাপ বেয়ে উঁচু ভবনে উঠেছে।
যেসব বিষধর সাপ পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে পদ্মগোখরা সাপই সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বলে জানান মি. আজাদ। ৩৫১টি সাপের মধ্যে প্রায় দুইশ সাপই পদ্মগোখরা বলে জানান তিনি।
গত দুই দিনে খিলগাঁও-এর কয়েকটি বাসা থেকে আটত্রিশটি পদ্মগোখরা সাপ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান আজাদ।
কেন ঢাকার মতো কংক্রিটের শহরে এত সাপ?
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনোম রিসার্চ সেন্টারের রিসার্চ এসোসিয়েট মো. মিজানুর রহমান মনে করেন, জলাশয় ও খালবিল ভরাট করে মানুষ বাসস্থান তৈরি করায় সাপের বাসস্থান সংকট তৈরি হয়েছে। তাই সাপ মানুষের বাসায় ঢুকে পড়ছে।
ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এসব সাপগুলো উদ্ধার করছে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা।
এই সংস্থার আহ্বায়ক আদনান আজাদ জানিয়েছেন, খিলগাঁওয়ের এক বাসায় তিনটা রুমের পুরা ফ্লোর ভেঙে মা সাপটা পেয়েছি। একই বাসা থেকে দুইটা বড় সাপ ও সাতটা বাচ্চা এবং আঠারটা পদ্মগোখরার ডিম উদ্ধার করেছি। গতকালকেও এক বাসা থেকে ১৮ টা পদ্মগোখরার বাচ্চা পেয়েছেন তারা।

আজাদ আরও জানান, এমনও হতে পারে নভেম্বর মাস জুড়ে আরো বেশি সাপ পাওয়া যাবে। কারণ অক্টোবর ও নভেম্বর পদ্মগোখরার প্রজননকাল।
তিনি মনে করেন, মানুষ বাসস্থানের কারণে জলাশয়, খাল-বিল, গর্ত ভরাট করায় সাপের বাসস্থান সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ” পাঁচ-ছয় বছর বা সাত বছর আগেও উত্তরার দিয়াবাড়িতে কোনো আবাসিক ভবন ছিল না, জলাশয় ছিলো। আফতাব নগরেরও একই অবস্থা। এই জলাশয়েই সাপের বাসস্থান ছিল। মানুষ নিজের আবাসনের জন্য এখানে বাসস্থান করেছে। ফলে সাপগুলো কোথায় গেছে? সাপের থাকার জায়গা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেছে। ফলে সে পেছনের যেসব প্লট যেখানে ভবন তৈরি হয়নি সেখানে চলে গেছে। ওই এলাকার গর্তে সে আবাস গড়েছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান জানান, “পদ্মগোখরা সাপ মূলত পানিপ্রেমী। নদী, জলাশয়, খাল-বিলে থাকতে পছন্দ করে। তবে, পানির নিকটস্থ ঝোপঝাড় ও গর্তেও এই সাপের দেখা মেলে।”
মেডিকেল কলেজের ভেনোম রিসার্চ সেন্টারের রিসার্চ এসোসিয়েট মো. মিজানুর রহমান জানান, মানুষ সাপের আবাসস্থল ধ্বংস করায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ” কোন কোন এলাকায় সাপগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। যেসব এলাকায় পাওয়া গেছে তার প্রতিটি জায়গায় জলাশয়, খাল-বিল ভরাট করে মানুষ বাসস্থান গড়ে তুলেছে। সাপ তার নিজের জায়গায়ই আছে কিন্তু আমরা তার জায়গায় চলে গেছি।”
এই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এতো সাপের দেখা মিলছে বিষয়টি স্বাভাবিক। কারণ আগে বাংলাদেশে সাপ উদ্ধারকারী সংগঠন কম ছিলো। মানুষ সাপ দেখলেই মেরে ফেলতো। কিন্তু এখন সাপ উদ্ধারের অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। উদ্ধারের খবরও বেশি প্রচারিত হচ্ছে।
প্রকৃতিবার্তা ডেস্ক 



















