২০২২ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা বসছে পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (বিবিসিএফইসি)। ঢাকা থেকে সরে যাওয়া মেলায় এবারই প্রথম যাওয়া। মেয়াদ বর্ধিত না করলে মেলার বাকী আছে আর ২ দিন। দুপুরের পর তেজগাঁও থেকে অফিসের গাড়িতে পূর্বাচলে রওনা হলো প্রকৃতিবার্তার টিম।
কাছাকাছি যেতেই মেলার বিপরীত পাশের এলাকায় ঢুকলো গাড়ি, পুরো রাস্তা ধুলায় ধূসর, আশপাশের গাছপালা, কলাবাগানের গাছগুলোর পাতায় পুরু ধুলার আস্তর।
গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে মেলার দিকে এগিতে যেতে চোখে পড়লো দেশের যেকোনো মেলার মতোই ঢাকা আন্তর্জাতি বাণিজ্য মেলার আশপাশে জমে ওঠা প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ।
মেলার ত্রিস্তরের গেটের প্রথমটির পাশেও জমে উঠেছে পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য। মেলা শেষে এই গোটা এলাকার চিত্রটা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।
গেট পেরিয়ে ঢুকতেই বিবিসিএফইসি’র স্থায়ী স্থাপনার শুরু। এখানেই কৃত্রিম প্লাস্টিক ঘাসের ওপর সাদা অক্ষরে বড় বড় করে লেখা ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার।
আপাতত টি এবং আর অক্ষর দু’টি দেখে বোঝা গেল পুরো লেখাটা সাদা বর্ণের, কারণ বাকী অক্ষরগুলোর উপরে পুরু হয়ে জমেছে বাদামী ধুলা।
আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে বিবিসিএফইসি’র সামনের ফোয়ারা, পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের পানি, জুসের বোতল, কফি কাপ, চিপসের প্যাকেট। দেশের জনপরিসরগুলোর সামনে দৃষ্টিনন্দন জলাধারগুলোর মতোই বেহাল হয়েছে এটির, প্লাস্টিক পিছু ছাড়েনি।
প্রদর্শনী কেন্দ্রের স্থায়ী অবকাঠামোর ভেতর ‘জুলাই চত্বরে’ স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট ধুলার ছাপ। জুলাই আন্দোলনের স্মরণে নির্মিত স্টলের বাইরে বিশাল ছবি, তারুণ্যের অগ্রযাত্রা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে।
সেই ছবিতে বিশাল দু’টি আবর্জনার বিন, রিসাইকেলের স্পষ্ট বার্তা দেয়া।
অথচ বাস্তবে এত বড় মেলার গেট দিয়ে ঢুকে দর্শনীয় এই প্রদর্শনী কেন্দ্রে ঢুকতে তখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত কোনো আবর্জনা ফেলার পাত্র চোখে পড়েনি।
মেলা ঘুরতে ঘুরতে কয়েকটি বিষয় চোখে পড়লো এবং কিছু ব্যাপারে প্রশ্ন জাগলো। প্রথমত মেলা প্রাঙ্গনে দেদারসে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার। ক্রেতাদের হাতে হাতে তো বটেই মেলা প্রাঙ্গন সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে।
পলিথিনের সঙ্গে রয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিপ্রোপাইলিন ব্যাগ, যাকে টিস্যু ব্যাগ নামে পরিবেশবান্ধব তকমা দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
মেলার ভেতর একটি জায়গায় জুলাই আন্দোলন স্মরণে ‘৩৬ চত্বর’। এর আশপাশে কিছু খাবার দোকান। এসব দোকানেও ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করতে দেখা গেল সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক অর্থাৎ সেই ওয়ান-টাইম প্লাস্টিকে প্লেট-গ্লাসে! এত আবর্জনা হলেও মেলায় ঘুরে সেই মাত্রায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দেখা মেলেনি।
৩৬ চত্বরেই কথা হলো সামরিক বাহিনীর সদস্য মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। মেলার পরিবেশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মেলায় আবর্জনা হবে, বেশিরভাগ পণ্যই প্লাস্টিক মোড়কের, প্লাস্টিক বর্জ্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মেলার আয়োজকদের এসব ময়লা অপসারণে যথেষ্ট আন্তরিক বলে মনে হলো না।
ডাস্টবিন আছে কিন্তু মেলার এত বড় জায়গা এবং এতো মানুষের তুলনায় কম। তবে প্রবেশসহ সার্বিক আয়োজনে শৃঙ্খলা দেখলাম। মেলার আয়োজকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া উচিত, কারণ এলোপাথাড়ি ময়লা পড়ে আছে। এর সঙ্গে আমাদেরও উচিত যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলার বদঅভ্যাস বাদ দেয়া, সভ্য হওয়া।’
মেলায় নিষিদ্ধ পলিথিনের পাশাপাশি পলিপ্রোপাইলিন বা তথাকথিত টিস্যু ব্যাগের ছড়াছড়ি। পলিথিন নিষিদ্ধের পর কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিতে কাপড়ের মতো দেখতে এই ব্যাগ ধুর্তদের জন্য যেন বিকল্প। একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানের এমনই ব্যাগ দেখা গেল বহু ক্রেতার কাছে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মেলায় এসে ৩৬ চত্বরের কাছে দাঁড়ানো মৌমিতার হাতেও এমন একটি বড় ব্যাগ। সেই ব্যাগে আবার বেশ ঘটা করে লেখা “পরিবেশ বান্ধব শপিং ব্যাগ”। ব্যাগটি কিভাবে পরিবেশবান্ধব সেটাও লেখা আছে এতে, এই ব্যাগ নাকি ডিটুডব্লিউ অক্সো-বায়োডিগ্রেডেবল! অর্থাৎ ব্যাগ সরবরাহকারীদের দাবি এই ব্যাগ পানি ও অক্সিজেনের সংস্পর্শে পচনশীল!
কিন্তু বাস্তবতা বলছে এসব শুভঙ্করের ফাঁকি। আসলেই যদি এটি ডিটুডব্লিউ হয় তবুও মুক্ত পরিবেশে এই ব্যাগ পচতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে!
আর দুঃখজনক হলেও সত্য পলিথিন-পলিপ্রোপাইলিন এবং এসবের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সাধারণ মানুষ এখনও খুব একটা মাথা ঘামায় না।
তবে মৌমিতা বলেন তিনি পলিথিনের ব্যাপারে সচেতন এজন্য পরিবেশবান্ধব ব্যাগ লেখা দেখে নিয়েছেন। আসলেই কি এই ব্যাগ পরিবেশবান্ধব? এমন প্রশ্নে দ্বিধান্বিত মৌমিতা বলেন, ‘এই ব্যাগ আসলেই পচনশীল কিনা সেব্যাপারে আইডিয়া নাই। ব্যাগেতো লেখা পরিবেশবান্ধব! পলিথিন খারাপ জেনেও আমরা ব্যবহার করে ফেলছি,আপাতত সহজ কোনো বিকল্প নাই।’
মেলার পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যুক্ত এমন একটি মেলার পরিবেশ আসলেই নোংরা।এর দায়ভার মেলা কর্তৃপক্ষের মতো সাধারণ মানুষেরও,কারণ তারা আবর্জনা সঠিক জায়গায় ফেলে না।’