মাত্র ৮ বর্গমাইল আয়তনের প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপদেশ নাউরু। দেশটি ঘোষণা করেছে তারা ১০৫,০০০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা) মূল্যে নাগরিকত্ব বিক্রি করছে।
এই ক্ষুদ্র, নিম্নভূমির দ্বীপটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ সংগ্রহের জন্য “গোল্ডেন পাসপোর্ট” উদ্যোগ চালু করেছে।
বাড়তে থাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ, শক্তিশালী ঝড় এবং উপকূলীয় ক্ষয়ের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশটি।
বিশ্বের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ নাউরু। তাদের নিজস্ব সম্পদ সীমিত, যা জলবায়ু সংকট মোকাবিলার প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়।
সরকার বলছে, নাগরিকত্ব বিক্রির মাধ্যমে যে আয় হবে, তা দিয়ে দ্বীপের প্রায় ১২,৫০০ জন বাসিন্দার ৯০ শতাংশকেই উঁচু জায়গায় স্থানান্তর করা সম্ভব।
“গোল্ডেন পাসপোর্ট” এর ধারণাটি মোটেও নতুন নয়। তবে একে ঘিরে আছে বেশ বিতর্ক। কারণ অতীতে অপরাধমূলক কাজে গোল্ডেন পাসপোর্ট ব্যবহারের অনেক উদাহরণ আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সেকারণে অনেক দেশকেই বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হয়। নাউরুর গোল্ডেন পাসপোর্ট এর উদ্যোগ সেরকমই একটি বিকল্প পথ।
নাউরুর প্রেসিডেন্ট ডেভিড আদেয়াং বলেছেন, “বিশ্ব যখন জলবায়ু নিয়ে বিতর্ক করছে, আমরা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার লক্ষ্যে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে চাইছি।“
নাউরুর নাগরিকত্বের জন্য ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৫,০০০ মার্কিন ডলার। তবে যাদের অতীতের নির্দিষ্ট অপরাধমূলক রেকর্ড আছে, তারা আবেদন করতে পারবে না।
নাউরুর পাসপোর্টধারীরা ৮৯টি দেশে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের সুবিধা নিতে পারবে – এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্যতম।
হয়তো নতুন পাসপোর্টধারীদের মধ্যে খুব কম মানুষই ছোট্ট দ্বীপদেশ নাউরু ভ্রমণ করবে। তবে এই নাগরিকত্ব থেকে অনেক মানুষ একটা “বৈশ্বিক জীবন” যাপনের সুযোগ পাবে, এমনটাই মনে করছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, কিরস্টিন সুরাক। তাঁর মতে, এই গোল্ডেন পাসপোর্টের উপকারীতা সেসব মানুষদের জন্য বেশি হবে, যাদের নিজ দেশের পাসপোর্টে ভ্রমণের সীমাবদ্ধতা বেশি।
১৯০০ দশকের শুরু থেকে প্রায় এক শতাব্দী ধরে, নাউরু দ্বীপটি ফসফেট খনির কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দ্বীপের প্রায় ৮০% অঞ্চল বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
বর্তমানে সেখানের বেশিরভাগ মানুষ উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করছে, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে।
দ্বীপের ফসফেট শেষ হয়ে গেলে, নাউরু নতুন অর্থনৈতিক উৎসের সন্ধান করতে থাকে। এরপর ২০০০ এর দশকের শুরুতে, নাউরুকে একটি আটককেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করা শরণার্থী ও অভিবাসীদের সেখানে রাখা হয়। তবে বন্দিদের মৃত্যুর ঘটনায়, এই কার্যক্রম সীমিত করে ফেলা হয়।
বর্তমানে, দ্বীপটি গভীর সমুদ্র থেকে খনিজ আহরণের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিদুতে রয়েছে। এ নিয়ে বেশ বিতর্কও চলছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্যোক্তা হিসেবে এখন কুখ্যাত, স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রাইড এর নজরও নাউরু দ্বীপের দিকে ছিলো। ২০২৩ সালের একটি মামলার নথি অনুযায়ী, তিনি দ্বীপটি কিনে সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন।
তবে নাউরুর বাসিন্দাদের জন্য, দ্বীপ দেশটি মোটেও ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না।
“উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী অনেকেই তাদের জমি হারিয়েছেন। কারও কারও সম্পূর্ণ বাড়ি সমুদ্রের জোয়ার এসে গ্রাস করে ফেলেছে,” এক বক্তব্যে বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিজনেস স্কুলের গবেষক এবং নাউরুর নাগরিক টাইরন ডেইয়ে।
অধ্যাপক কিরস্টিন সুরাক এর মতে, “নাগরিকত্ব বিক্রি ছোট, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।”
প্রথম বছরেই এই উদ্যোগ থেকে আনুমানিক ৫.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করার আশা করছে নাউরুর সরকার। এটি ধীরে ধীরে বছরে ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়বে।
সরকার আশা করছে, এই উদ্যোগ একসময় সরকারি আয়ের ১৯ শতাংশ পূরণ করবে।
এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে অর্থের যথাযথ ব্যবহার এবং স্বচ্ছতার ওপর। পূর্বে এরকমই একটি নাগরিকত্ব বিক্রির কর্মসূচি নিয়ে কেলেঙ্কারি সৃষ্টি হয়েছিলো। ২০০৩ সালে, মালয়েশিয়ায় ধরা পড়া দুইজন আল-কায়েদার সদস্যকে নাউরুর পাসপোর্টসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
নাউরুর সরকার বলছে, এবারের কর্মসূচির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বেশ কঠোর হবে। জাতিসংঘের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, যার মধ্যে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে।
নাউরু প্রথম দেশ নয় যারা জলবায়ু কর্মসূচির জন্য পাসপোর্ট বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। ক্যারিবীয় দেশ ডোমিনিকা ১৯৯৩ সাল থেকে নাগরিকত্ব বিক্রি করছে। তারা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, তাদের আয়ের একটি অংশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রথম জলবায়ু-সহনশীল দেশ হয়ে ওঠার লক্ষ্য পূরণে ব্যবহার হচ্ছে।
এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। কারণ, উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যয় বহন করতে পারছে না, আর আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল ক্রমশ শুকিয়ে আসছে।
নাউরুর অর্থনৈতিক ও জলবায়ু সহনশীলতা কর্মসূচির প্রধান এডওয়ার্ড ক্লার্ক বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য, নাউরু একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র হতে পারে।”