তেজগাঁওয়ের অশ্বত্থবৃক্ষ

তেজগাঁওয়ের অশ্বত্থবৃক্ষ

“বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।” আমাদের দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবনে চলার পথে প্রতিটি পরতে পরতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়েন কবিগুরু! না, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও ঘুরতে আসেননি। কিংবা যাকে কেন্দ্র করে আজকের এই ক্যাঁচাল, সেখানেও নেই তার কোন অবদান। তবুও কালের সাক্ষী তেজগাঁওয়ের এই অশ্বত্থ বৃক্ষটিকে নিয়ে লিখতে বসে স্মৃতির মানসপটে সআভিজাত্যে হাজির তিনি। এ যেন ধান ভানতে শীবের গীত।

বিষয়টা একটু খোলাসা করি। আমার মতো অনেকের প্রাত্যহিক রোজনামচায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এই বৃক্ষটি। সাতসকালে অফিসে ঢোকার আগে কিংবা অফিস শেষে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় গাছতলার টং দোকানের চায়ের কাপে একটু চুমুক না দিলেই যেন নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই মাথার মধ্যে অবিরাম খেলা করে চলে নিত্য-নতুন শব্দ-পঙতিমালা। লেখার খাতায় যেগুলো হয়ে ওঠে সজীব-প্রাণবন্ত জীবনের আবাহন। প্রতিদিনের অভ্যস্থতায় আজ সকালেও যখন অশ্বত্থ গাছটির নিচে পৌঁছেছি, তখন হঠাৎ-ই হালকা হাওয়া শীতলতার পরশ বুলিয়ে যায় সারা শরীর ও মননে। মনের অজান্তেই ভেতর থেকে কে যেন স্মরণ করিয়ে দেয় উপরোক্ত পংক্তিমালা, নির্মম উপলব্ধি!

“বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’, রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ”- গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের শাশ্বত উপলব্ধিতে কতই না চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই বঙ্গভূমির চিরন্তন প্রাকৃতিক আভিজাত্য। আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ অশ্বত্থ বৃক্ষের সগর্ব অভিভাবকত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন এভাবে-

“বলিল অশ্বত্থ ধীরে; ‘কোন দিকে যাবে বলো—

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এত দিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে;

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো—আজো তো দাঁড়ায়ে তারা আছে।”

ইট-পাথর-বালি-সিমেন্টের সমন্বয়ে কংক্রিটের এই হৃদয়হীন ঢাকা শহর থেকে খোড়ো ঘরগুলি বিতাড়িত হয়েছে বহু বছর আগেই। জাদুঘরেও এখন তাদের অস্তিত্ব মেলা ভার! ভাগ্যিস জীবনানন্দ এখন আর ধরাধামে বেঁচে নেই। থাকলে এই বুড়ো-থুবড়ো অশ্বত্থকে ম্লান খোড়ো ঘরগুলির অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেওয়ার অপরাধে একটু লজ্জাই পেতেন বোধহয়, কিছুটা আত্ম-গ্লানিতেও ভুগতেন কি?

তেজগাঁও নাবিস্কো মোড় থেকে পূর্ব দিকে পায়ে হেঁটে মিনিট খানিক এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে পিচ ঢালা সড়কের বামপাশে মহাকালের সাক্ষী হিসেবে সগর্বে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বত্থ গাছটি। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পারি গল্পের প্যারিস শহর অবলম্বনে সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে একটু ঘুরিয়ে তাই বলাই যায়, “শত শত বছর বয়স, তবু চুল তার পাকলো না”। যদিও সামনে-পেছনে বেশ কয়েকটি উঁচু অট্টালিকার সারি তাকে দমিয়ে রাখার উদ্ধত-অহংকারী চেষ্টায় মত্ত। এর মাঝেও তার অভিব্যক্তি, “যেন মাথা নোয়াবার নয়” অথবা “হাজারো ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, ইতিহাসের হাত ধরে, প্রগতির মহারথে, সভ্যতার ঊষালগ্নে আজ আমি এসেছি এখানে; তোমাকে ধরতে নয় হে স্বাধীনতা, তোমার কাছে ধরা দিতে”! কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট, কৃত্রিম এই সংকট মোকাবেলা করে আর কতদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অশ্বত্থ বৃক্ষটি অনাগত ভবিষ্যৎই হয়তো জানে তার সঠিক হিসাব। তবে শত সংগ্রাম শেষে যেদিন মুখ থুবড়ে পড়বে গাছটি সেদিন পাপের হিসাব ষোলআনা পূর্ণ হবে প্রকৃতির শত্রুদের। যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে অত্র অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। চব্বিশ ঘণ্টাই অক্সিজেনের অফুরন্ত উৎস অশ্বত্থ বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ হয় নাম না জানা অসংখ্য পাখ-পাখালি, পোকামাকড় এবং খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষের। গাছটির নিচে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন অনেকেই। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে প্রাণিকুল যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তখন এই বৃক্ষের স্নেহের পরশে নিজেকে বিলিয়ে দেন পথচারীরা। বিশ্রাম শেষে তাদের প্রশান্ত দেহ-মনে খেলা করে প্রফুল্লতা। প্রখর রৌদ্রে কিংবা ভরা বর্ষায় ক্লান্ত-অবসন্ন-জীর্ণ-শীর্ণ রিকশা বা ভ্যানচালক এখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেন পরম নির্ভরতায়। কিছু খাবার খেয়ে পুনরায় নিয়োজিত হন আপন কর্মে।

অশ্বত্থ, অশথ বা পিপুল বট বা ডুমুর জাতীয় এক প্রকার বৃক্ষ, ভারতীয় উপমহাদেশ যার আদি নিবাস। এছাড়া ইন্দোচীন, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ পশ্চিম চীন ইত্যাদি দেশেও বৃক্ষটির উপস্থিতি আছে। Moraceae পরিবারভুক্ত সপুষ্পক এই উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus religiosa. বট গাছের মতো অশ্বত্থ গাছে ঝুরিমূল থাকে না। সাম্প্রতিককালে এই গাছের বনসাই অর্জন করেছে জনপ্রিয়তা। দীর্ঘজীবী এই গাছের গড় আয়ু ৯০০-১৫০০ বছর পর্যন্ত। কোথাও কোথাও এটি তিন হাজার বছর বেঁচে থাকে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন শহর অনুরাধাপুরের পিপুল গাছ জয়া শ্রী মহা বোধি’র বয়স ২২৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়; যা বিশ্বের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক ধর্মীয় গুরুত্ববহনকারী বৃক্ষ। গৌতম বুদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বসে ধ্যান করে বোধি (জ্ঞান) লাভ করেন, সেই জন্য এটাকে বোধিবৃক্ষও বলা হয়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশীয় অঞ্চলের আদি নিবাসী হলেও বর্তমানে প্রায় বিশ্বজুড়ে এর উপস্থিতি। কোথাও বা চাষ করা হয়েছে, কোথাও বা এটি অভিযোজিত হয়েছে প্রাকৃতিকভাবেই। সনাতন, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে অশ্বত্থ বৃক্ষকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করা হয়। এই বৃক্ষের ভেষজ গুণাগুণও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, গর্ভধারণজনিত জটিলতা, নাক দিয়ে রক্তপড়া, শ্বাসকষ্ট, কৃমি, দাঁতব্যথা, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, মৃগীরোগ, গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা, প্রদাহজনিত রোগ, সংক্রামক এবং যৌন রোগ সহ প্রায় পঞ্চাশ ধরনের রোগে অশ্বত্থ গাছের ব্যবহার লক্ষণীয়।

ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট বলেছেন, “যে জাতি তার মাটিকে ধ্বংস করে, সে নিজেকে ধ্বংস করে। বন হলো আমাদের ভূমির ফুসফুস, যা বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং আমাদের সতেজ শক্তি দেয়।” তাই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, অনাগত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে প্রকৃতির স্নেহের আশীর্বাদ, তেজগাঁওয়ের অশ্বত্থ বৃক্ষটির পাশাপাশি ছোটবড় সকল বৃক্ষকে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সুস্থ-সমৃদ্ধ প্রতিবেশ ব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো আগামীর শিশুদের জন্য এই হোক আমাদের একান্ত প্রত্যয়-

“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান:

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাবো, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

আপলোডকারীর তথ্য

চবি’র কলোনি থেকে ৯ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার  

তেজগাঁওয়ের অশ্বত্থবৃক্ষ

আপডেট সময় ০৩:৪৩:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫

“বহু দিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।” আমাদের দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবনে চলার পথে প্রতিটি পরতে পরতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়েন কবিগুরু! না, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও ঘুরতে আসেননি। কিংবা যাকে কেন্দ্র করে আজকের এই ক্যাঁচাল, সেখানেও নেই তার কোন অবদান। তবুও কালের সাক্ষী তেজগাঁওয়ের এই অশ্বত্থ বৃক্ষটিকে নিয়ে লিখতে বসে স্মৃতির মানসপটে সআভিজাত্যে হাজির তিনি। এ যেন ধান ভানতে শীবের গীত।

বিষয়টা একটু খোলাসা করি। আমার মতো অনেকের প্রাত্যহিক রোজনামচায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এই বৃক্ষটি। সাতসকালে অফিসে ঢোকার আগে কিংবা অফিস শেষে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় গাছতলার টং দোকানের চায়ের কাপে একটু চুমুক না দিলেই যেন নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই মাথার মধ্যে অবিরাম খেলা করে চলে নিত্য-নতুন শব্দ-পঙতিমালা। লেখার খাতায় যেগুলো হয়ে ওঠে সজীব-প্রাণবন্ত জীবনের আবাহন। প্রতিদিনের অভ্যস্থতায় আজ সকালেও যখন অশ্বত্থ গাছটির নিচে পৌঁছেছি, তখন হঠাৎ-ই হালকা হাওয়া শীতলতার পরশ বুলিয়ে যায় সারা শরীর ও মননে। মনের অজান্তেই ভেতর থেকে কে যেন স্মরণ করিয়ে দেয় উপরোক্ত পংক্তিমালা, নির্মম উপলব্ধি!

“বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’, রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ”- গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের শাশ্বত উপলব্ধিতে কতই না চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই বঙ্গভূমির চিরন্তন প্রাকৃতিক আভিজাত্য। আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ অশ্বত্থ বৃক্ষের সগর্ব অভিভাবকত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন এভাবে-

“বলিল অশ্বত্থ ধীরে; ‘কোন দিকে যাবে বলো—

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এত দিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে;

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো—আজো তো দাঁড়ায়ে তারা আছে।”

ইট-পাথর-বালি-সিমেন্টের সমন্বয়ে কংক্রিটের এই হৃদয়হীন ঢাকা শহর থেকে খোড়ো ঘরগুলি বিতাড়িত হয়েছে বহু বছর আগেই। জাদুঘরেও এখন তাদের অস্তিত্ব মেলা ভার! ভাগ্যিস জীবনানন্দ এখন আর ধরাধামে বেঁচে নেই। থাকলে এই বুড়ো-থুবড়ো অশ্বত্থকে ম্লান খোড়ো ঘরগুলির অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দেওয়ার অপরাধে একটু লজ্জাই পেতেন বোধহয়, কিছুটা আত্ম-গ্লানিতেও ভুগতেন কি?

তেজগাঁও নাবিস্কো মোড় থেকে পূর্ব দিকে পায়ে হেঁটে মিনিট খানিক এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে পিচ ঢালা সড়কের বামপাশে মহাকালের সাক্ষী হিসেবে সগর্বে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বত্থ গাছটি। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পারি গল্পের প্যারিস শহর অবলম্বনে সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে একটু ঘুরিয়ে তাই বলাই যায়, “শত শত বছর বয়স, তবু চুল তার পাকলো না”। যদিও সামনে-পেছনে বেশ কয়েকটি উঁচু অট্টালিকার সারি তাকে দমিয়ে রাখার উদ্ধত-অহংকারী চেষ্টায় মত্ত। এর মাঝেও তার অভিব্যক্তি, “যেন মাথা নোয়াবার নয়” অথবা “হাজারো ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, ইতিহাসের হাত ধরে, প্রগতির মহারথে, সভ্যতার ঊষালগ্নে আজ আমি এসেছি এখানে; তোমাকে ধরতে নয় হে স্বাধীনতা, তোমার কাছে ধরা দিতে”! কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট, কৃত্রিম এই সংকট মোকাবেলা করে আর কতদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অশ্বত্থ বৃক্ষটি অনাগত ভবিষ্যৎই হয়তো জানে তার সঠিক হিসাব। তবে শত সংগ্রাম শেষে যেদিন মুখ থুবড়ে পড়বে গাছটি সেদিন পাপের হিসাব ষোলআনা পূর্ণ হবে প্রকৃতির শত্রুদের। যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে অত্র অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। চব্বিশ ঘণ্টাই অক্সিজেনের অফুরন্ত উৎস অশ্বত্থ বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ হয় নাম না জানা অসংখ্য পাখ-পাখালি, পোকামাকড় এবং খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষের। গাছটির নিচে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন অনেকেই। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে প্রাণিকুল যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তখন এই বৃক্ষের স্নেহের পরশে নিজেকে বিলিয়ে দেন পথচারীরা। বিশ্রাম শেষে তাদের প্রশান্ত দেহ-মনে খেলা করে প্রফুল্লতা। প্রখর রৌদ্রে কিংবা ভরা বর্ষায় ক্লান্ত-অবসন্ন-জীর্ণ-শীর্ণ রিকশা বা ভ্যানচালক এখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেন পরম নির্ভরতায়। কিছু খাবার খেয়ে পুনরায় নিয়োজিত হন আপন কর্মে।

অশ্বত্থ, অশথ বা পিপুল বট বা ডুমুর জাতীয় এক প্রকার বৃক্ষ, ভারতীয় উপমহাদেশ যার আদি নিবাস। এছাড়া ইন্দোচীন, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ পশ্চিম চীন ইত্যাদি দেশেও বৃক্ষটির উপস্থিতি আছে। Moraceae পরিবারভুক্ত সপুষ্পক এই উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus religiosa. বট গাছের মতো অশ্বত্থ গাছে ঝুরিমূল থাকে না। সাম্প্রতিককালে এই গাছের বনসাই অর্জন করেছে জনপ্রিয়তা। দীর্ঘজীবী এই গাছের গড় আয়ু ৯০০-১৫০০ বছর পর্যন্ত। কোথাও কোথাও এটি তিন হাজার বছর বেঁচে থাকে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন শহর অনুরাধাপুরের পিপুল গাছ জয়া শ্রী মহা বোধি’র বয়স ২২৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়; যা বিশ্বের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক ধর্মীয় গুরুত্ববহনকারী বৃক্ষ। গৌতম বুদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বসে ধ্যান করে বোধি (জ্ঞান) লাভ করেন, সেই জন্য এটাকে বোধিবৃক্ষও বলা হয়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশীয় অঞ্চলের আদি নিবাসী হলেও বর্তমানে প্রায় বিশ্বজুড়ে এর উপস্থিতি। কোথাও বা চাষ করা হয়েছে, কোথাও বা এটি অভিযোজিত হয়েছে প্রাকৃতিকভাবেই। সনাতন, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে অশ্বত্থ বৃক্ষকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করা হয়। এই বৃক্ষের ভেষজ গুণাগুণও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, গর্ভধারণজনিত জটিলতা, নাক দিয়ে রক্তপড়া, শ্বাসকষ্ট, কৃমি, দাঁতব্যথা, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, মৃগীরোগ, গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা, প্রদাহজনিত রোগ, সংক্রামক এবং যৌন রোগ সহ প্রায় পঞ্চাশ ধরনের রোগে অশ্বত্থ গাছের ব্যবহার লক্ষণীয়।

ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট বলেছেন, “যে জাতি তার মাটিকে ধ্বংস করে, সে নিজেকে ধ্বংস করে। বন হলো আমাদের ভূমির ফুসফুস, যা বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং আমাদের সতেজ শক্তি দেয়।” তাই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, অনাগত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে প্রকৃতির স্নেহের আশীর্বাদ, তেজগাঁওয়ের অশ্বত্থ বৃক্ষটির পাশাপাশি ছোটবড় সকল বৃক্ষকে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা, সুস্থ-সমৃদ্ধ প্রতিবেশ ব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো আগামীর শিশুদের জন্য এই হোক আমাদের একান্ত প্রত্যয়-

“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান:

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাবো, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”