বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও বাংলাদেশে আরেকটি দুর্যোগ দিন দিন বাড়ছে, সেটি হলো বজ্রপাত, অথচ বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাসে প্রযুক্তির ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। আর যেখানে এই প্রযুক্তি দরকার সেখানে প্রয়োগ না করে নামেমাত্র কাজ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে উপকূলীয় জেলাগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনসহনশীল অবকাঠামো তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমন দিবসে দেশের দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থার চিত্র উঠে এসেছে দু’টি সংবাদমাধ্যমে।
জাগোনিউজের একটি প্রতিবেদনে শিরোনাম করা হয়েছে: “বজ্রপাতে মানুষ মরে হাওরে, যন্ত্র বসেছে সাবেক এমপির বাড়ির সামনে।”
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হাওর ও বনাঞ্চল বেষ্টিত। ফলে এসব হাওর এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাত এক আতঙ্কের নাম। বজ্রপাতে জেলায় প্রতি বছর ১৪ মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বজ্রপাত রোধে জেলায় ৩৩টি বজ্র নিরোধক বা লাইটিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। অথচ উপজেলা অফিস ও সাবেক এমপির বাড়ির সামনে বসানো এসব যন্ত্র আদৌ কোনো কাজ করে কি না বলতে পারছে না কেউ।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জেলায় গত ছয় বছরে (চলতি মৌসুমসহ) বজ্রপাতে মারা গেছে ৮৪ জন। প্রতি বছর গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মাঝে চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ১১ জন। আহত হয়েছে ৩ জন। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ২০২২ সালে ২২ জন। আহত হয় ৩ জন। এছাড়া ২০২০ সালে মারা যায় ১৫ জন, আহত হয় ৪ জন। ২০২১ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ২ জন। ২০২৩ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ১ জন। ২০২৪ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ২ জন।
জেলায় মোট হাওর আছে ১ হাজার ৯৫ বর্গ কিলোমিটার। পুরো হাওর লাইটিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক যন্ত্রের আওতায় আনতে হলে মোট ৩০ হাজার ৬৬০টি যন্ত্রের প্রয়োজন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৮টি করে)। এতে ব্যয় দাঁড়াবে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।
অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০ লাখ, বানিয়াচংয়ে ৪৫ লাখ, আজমিরীগঞ্জে ৩০ লাখ, হবিগঞ্জ সদরে ১৫ লাখ, লাখাইয়ে ২৫ লাখ, শায়েস্তাগঞ্জে ১০ লাখ, চুনারুঘাটে ১৫ লাখ ও মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়ে ৯টি উপজেলায় ৩৩টি লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপন করা হয়। এর মাঝে নবীগঞ্জে ৬টি, বাহুবলে ২টি, বানিয়াচংয়ে ৭টি, আজমিরীগঞ্জে ৬টি, হবিগঞ্জ সদরে ৩টি, লাখাইয়ে ৩টি, শায়েস্তাগঞ্জে ২টি, চুনারুঘাটে ২টি ও মাধবপুরে ২টি। এগুলো ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই স্থাপন করা হয়।
এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বজ্র নিরোধক বসানো নিয়ে রয়েছে বিতর্ক, এলাকাবাসীর ক্ষোভ। আজমিরীগঞ্জে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানো হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশে। কোনোটি বসানো হয়েছে বাড়িঘরের কাছাকাছি। বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুরে বসানো হয়েছে সাবেক এমপি (বর্তমানে কারান্তরীণ) আব্দুল মজিদ খানের বাড়ির সামনে। একটি যন্ত্রের কোথাও বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। কোথাও একটি যন্ত্রও হাওরে স্থাপন করতে দেখা যায়নি।
একই দিন বাংলাট্রিবিউনে প্রকাশিত আরেকটি খবরের শিরোনাম: “ড্রেনেজ ছাড়াই সড়ক নির্মাণ, জলবায়ু প্রকল্পে নেই জলবায়ু পরিকল্পনা।”
এই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে: বহুল প্রতীক্ষিত সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হলেও তা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে স্বস্তির বদলে হতাশার জন্ম দিয়েছে। কারণ জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে সড়কটি। স্থানীয়রা বলছেন, এই উন্নয়নকাজ টেকসই হবে না। বরং কয়েক মাসের মধ্যেই বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে সড়কটি। জলে যাবে প্রকল্পের তিন কোটি টাকার বেশি।
সাতক্ষীরার পোস্ট অফিস মোড় থেকে হাটখোলা মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় আছে। সড়ক দিয়ে দিনে হাজারো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হয়। অবশেষে জলবায়ু অর্থায়নের আওতায় নির্মাণ শুরু হলেও মূল সমস্যা উপেক্ষিত থাকছে। অল্প বৃষ্টিতেই সরকারি কলেজ মাঠ ও আশপাশের এলাকায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়। সম্প্রতি বৃষ্টিতেই কলেজ ক্যাম্পাসসহ শহরের বড় অংশ প্লাবিত হয়েছিল। সড়কটি নতুন করে তৈরি করা হলেও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রকল্পে যদি জলবায়ুর পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন ও নগরীর পানি প্রবাহের চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় না নেয়, তবে তাকে জলবায়ু সহনশীল বলা যায় না।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন জেলা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী। তিনি বলেন, ‘বছরের ছয়-সাত পানিতে ডুবে থেকে এই এলাকার অধিক রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর। তারপরও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সড়ক কোনোভাবেই টিকবে না।’
প্রকৃতিবার্তা ডেস্ক 



















