আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। নদীর দেশে চরাঞ্চল, খাল-বিল, হাওর-বাওরে সমৃদ্ধ বাংলার সুবিশাল জলাভূমি। দক্ষিণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সুন্দরবন। সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবুজ টিলা আর চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়। সব মিলিয়ে বৈচিত্রে ভরা বাংলার প্রকৃতি জীববৈচিত্রেও সমৃদ্ধ। কিন্তু মানুষের লোভ, বিবেকহীন শখসহ মানবসৃষ্ট নানা বিপদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীববৈচিত্র্য, দেশের সম্পদ বন্যপ্রাণীরা থাকে নানা ঝুঁকিতে। এই বাস্তবতায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করছে বনবিভাগ। তবে লোকবল সংকট, অর্থায়ন, দুর্গম অঞ্চল, দক্ষতার অভাবের মতো কারণগুলো দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। অবশ্য আশার কথা যে, দেরীতে হলেও বাংলাদেশ তার বন্যপ্রাণী রক্ষায় আন্তরিক হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। বাঘগণনা, শুশুক, ডলফিন গণনার মতো জটিল বিষয়গুলোতে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। বন্যপ্রাণী পাচার, হত্যাসহ যাবতীয় অবৈধ কাজ বন্ধে বন্যপ্রাণী বিষয়ক অপরাধ দমন ইউনিট (ডব্লিউসিসিইউ) চালু হয়েছে। বন্যপ্রাণী রক্ষায় ডব্লিউসিসিইউ করছে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহারের সুফলও মিলছে। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহারের সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক মার্কিন সংবাদমাধ্যম মংগাবে। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পরিযায়ী পাখি রক্ষায় ডব্লিউসিসিইউ এর সার্ভেইলেন্স ড্রোন ব্যবহারের সাফল্যকথা। প্রতিবেদনে ডব্লিউসিসিইউ এর পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আস-সাদিক তুলে ধরেছেন ড্রোন ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের অভিজ্ঞতার কথা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল নভেম্বরে গোপালগঞ্জে পাখির অভয়াশ্রমে ড্রোন উড়িয়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে হাত পাকানোর চেষ্টা করছিলেন সাদিক। এক বিকেলে একটি বিলের ওপর দিয়ে ড্রোন ওড়ানোর সময় সাদিক স্ক্রিনে দেখতে পান পাতলা নাইলনের সুতায় তৈরি অসংখ্য ফাঁস। সেসবে আটকে ছটফট করছে পাখিরা।
এরপর চলে অভিযান যাতে কয়েকটি পাখি উদ্ধার করা হয়। ধারালো নাইলন ফাঁসের কারণে অনেকগুলোকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। তবে ওসব পাখি শিকারের ফাঁদ জব্দসহ দুইজন অবৈধ কারবারিকে আটক করা হয়। ধ্বংস করা হয় নাইলনের ফাঁদ।
বন্যপ্রাণী,পাখি রক্ষায় ডব্লিউসিসিইউ দেশজুড়েই এরকম কাজ করে চলেছে। এই কাজে ডব্লিউসিসিইউ সদস্যদের সহায়তা করছে প্রযুক্তি। বোদ্ধামহলে সুপরিচিত মংগাবে-তে ফিচার হওয়া ডব্লিউসিসিইউ এর পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আস-সাদিকের সঙ্গে কথা হয় প্রকৃতিবার্তার।
সাদিক বলেন, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সংরক্ষণ কার্যক্রমকে আরো কার্যকর এবং দক্ষ করে তুলেছে। বন্যপ্রাণী, পাখিরা থাকে দুর্গম এলাকায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিস্তীর্ণ এলাকায় যাওয়া কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। এই যেমন জলাভূমিতে কাদার মধ্যে পাখির অভয়াশ্রমের বিশাল এলাকাগুলোয় সশরীরে নজর রাখাটা বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজ সহজ করেছে নজরদারী ড্রোন।’

শুধু ড্রোন দিয়ে নজরদারী নয়, দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় আরও কিছু আধুনিক প্রযুক্তি কাজে আসছে। এব্যাপারে সাদিক জানান, বন্যপ্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য জিপিএস এবং স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি বন্যপ্রাণীর চলাচল, আবাসস্থল এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে।
ক্যামেরা ট্র্যাপ বনের গভীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তুলতে পারে। এটি বিরল প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করতে এবং তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। আগে পাগ মার্ক দিয়ে বাঘ গণনায় অনেক বিভ্রান্তি হতো, এখন ক্যামেরা ট্র্যাপে মোটামুটি নির্ভুলভাবে গণনা করা যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, এছাড়া স্মার্ট কলার এবং সেন্সর প্রযুক্তি বন্যপ্রাণী এবং তাদের বাসস্থান পর্যবেক্ষণ করে। এটি পরিবেশগত পরিবর্তন বা হুমকির আগাম সতর্কবার্তা প্রদান করে। এআই-ভিত্তিক সফটওয়্যার বন্যপ্রাণীর ছবি ও ডেটা বিশ্লেষণ করে। এটি প্রজাতি শনাক্ত, অভ্যাস পর্যবেক্ষণ এবং হুমকির পূর্বাভাস দিতে পারে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রচেষ্টার স্বীকৃতিও পেতে শুরু করেছে ডব্লিউসিসিইউ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত পাখিমেলায় পাখি সংরক্ষণ প্রচেষ্টার জন্য বিশেষ সম্মাননা অর্জন করেছে এই ইউনিট।
সাদিক বলেন, উন্নত প্রযুক্তির এই ব্যবহার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে আরও কার্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত করে তুলেছে। তবে, এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।