জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিশেষ অবদানের জন্য নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাব এর পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবু।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) নটর ডেম কলেজে অনুষ্ঠিত ১৫তম জাতীয় প্রকৃতি সম্মেলনে তাঁকে এই সম্মাননা পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এছাড়াও নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মডারেটর মিজানুর রহমান ভূঁইয়া এবং অধ্যক্ষ ড. হেমন্ত পিউস রোজারিওকেও জানানো হয়েছে আজীবন সম্মাননা। প্রধান অতিথি তাদের হাতে সম্মাননা পুরস্কার তুলে দেন।
আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হওয়া বক্তব্যে নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘নটর ডেম নেচার স্টাডি ক্লাব ৪০ বছর অতিক্রম করেছে। অনেক আগে থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নানা বিষয়ে, বিশেষ করে পরিবেশ নিয়ে যখন কেউ ভাবেনি তখন নটর ডেম কলেজ পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করেছে। আমি গর্বিত যে আমি এই কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলাম।’
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘প্রকৃতি-পরিবেশ ভাল না থাকলে, আমরাও যে ভাল থাকবো না তা নানাভাবে আমরা এখন বুঝতে পারছি। অথচ আমাদেরই কারণে দিন দিন প্রকৃতি রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস এই সম্মেলনে আজকে আমরা যারা এসেছি তারা প্রকৃতিকে ভালোবাসি বলেই এসেছি। এই বিশ্বাস থেকেই বলবো সবাই মিলে প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় আমরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলেই নতুন প্রজন্মের জন্য ভাল পরিবেশ রেখে যেতে পারবো।’
মুকিত মজুমদার বাবু প্রকৃতি সংরক্ষণে, প্রাণ প্রকৃতিকে ভালোবেসে নিজের বিলাসী জীবন উৎসর্গ করেছেন। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৭৮ সালে বিদেশে যান। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষে ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরেন তিনি। শুরু করেন ব্যবসা। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ইমপ্রেস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক তিনি। তবে ব্যবসায়ী পরিচয় ছাপিয়ে দেশ-বিদেশে তিনি ‘প্রকৃতিবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত।
১৯৭১ সালে ছাত্রাবস্থায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মুকিত মজুমদার বাবু। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেন প্রিয় মাতৃভূমি। তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবেসে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পথে-প্রান্তরে। কাজ করেছেন সুস্থ প্রকৃতি গড়ার প্রত্যয়ে। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে।
‘সুন্দর প্রকৃতিতে গড়ি সুস্থ জীবন’ প্রতিপাদ্যে ২০০৯ সালে মুকিত মজুমদার বাবু প্রতিষ্ঠা করেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন মুকিত মজুমদার বাবু ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন।
বন্যপ্রাণী অবমুক্তকরণ, প্রতি বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ, দেশি প্রজাতির বৃক্ষরোপণ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রকৃতি বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, প্রজাপতি পার্ক প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক, বিভিন্ন পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মশালা, পাখিশুমারি ও পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণ, মহাবিপন্ন বড়কাইট্টা কাছিম প্রজনন ও সংরক্ষণ, বিপন্ন শকুন সংরক্ষণ, শিকারি পাখি গবেষণা ও সংরক্ষণ, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় গাছের পরিচিতি ফলক সংযুক্তিকরণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া, পরিবেশ সচেতনতামূলক স্কুল প্রোগ্রাম, প্রকৃতি পল্লী প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রাণ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অবদান রাখা ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করতে মুকিত মজুমদার বাবু প্রণয়ন করেন ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক’। প্রতিবছর এসব বিষয়ে অবদান রাখা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এ পদক পেয়ে থাকেন। এ পদকের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই আজ প্রকৃতি রক্ষায় নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
মুকিত মজুমদার বাবুর উদ্যোগে শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে উদযাপিত হয় ‘প্রকৃতি মেলা’। প্রকৃতি মেলার মাধ্যমে শহরকেন্দ্রিক মানুষ প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন, জানতে পারেন জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে। এতে করে মানুষের ভালোবাসা জন্মে প্রকৃতির প্রতি এবং সচেতনতাবোধ জাগ্রত হয় পরিবেশ রক্ষায়।
মুকিত মজুমদার বাবু দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছে প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ক্লাবের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। ‘সবুজে সাজাই বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে গত বছর প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব সারাদেশে ১০ লক্ষাধিক গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ করেছে। চলতি বছরও এই কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
মুকিত মজুমদার বাবু ২০১২ সালের ২১ জুন প্রতিষ্ঠা করেন প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা সেখানে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলাতে ক্যাম্প করে দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। স্কুলের শিশুদের নিয়মিত দেয়া হচ্ছে খাদ্য ও শিক্ষাসামগ্রী। শীত, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষদের দেয়া হয় শীতবস্ত্র ও ত্রাণ। দেশের প্রান্তিক ও অবহেলিত মানুষের জন্য জীবিকার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও টেকসই জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০২২ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে ‘পরিবেশবান্ধব বিকল্প আয়’ কার্যক্রম। এ কর্মসূচির আওতায় গরু ও ছাগল পালন, টেইলারিং শপ, মুদি দোকান, ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোগ, ইজিবাইক, মৎস্য চাষ ইত্যাদি বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন ‘প্রকৃতিবার্তা’। দেশবিদেশের প্রকৃতিবিষয়ক সাম্প্রতিক সংবাদ প্রকাশের জন্য চালু করা হয়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রকৃতিবার্তা ডটকম (prokritibarta.com)। মুকিত মজুমদার বাবু প্রকৃতিবার্তার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি।
মুকিত মজুমদার বাবুর উদ্যোগে সংগীতের মাধ্যমে পরিবেশ ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ‘সবুজ সুরে রাঙাই জীবন’ স্লোগানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘প্রকৃতি ও জীবন মিউজিক ক্লাব’। এ সংগঠনের লক্ষ্য হলো সংগীতানুষ্ঠান, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিচর্চা ও পরিবেশবিষয়ক গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিকে নিয়মিত লিখছেন মুকিত মজুমদার বাবু। একুশে বইমেলায় প্রতিবছর প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক নানা ধরনের বই। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে-‘আমার অনেক ঋণ আছে’, ‘আমার দেশ আমার প্রকৃতি’, ‘আমার রূপসী বাংলা’ ‘সবুজ আমার ভালোবাসা’, ‘স্বপ্নের প্রকৃতি’, ‘সবুজে সাজাই আমার বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।
পরিবেশ বিষয়ক বহুমাত্রিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবু ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ “জাতীয় পরিবেশ পদক” “এইচএসবিসি-দি ডেইলি স্টার ক্লাইমেট এ্যাওয়ার্ড” “মার্ক এঞ্জেলো রিভার অ্যাওর্য়াড” “ঢাকা আহছানিয়া মিশন চাঁদ সুলতানা পুরস্কার” “ফোবানা এ্যাওয়ার্ড ইউএসএ” “বিজনেস এক্সিলেন্সি এ্যাওয়ার্ড সিঙ্গাপুর” “পল্লীমাগ্রিন স্বর্ণপদক” “এ ফ্রেন্ড অব নেচার” সহ বিভিন্ন সম্মাননা অর্জন করেছেন।