লালমাটি, শালবন, নদী-খাল-বিল এবং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জেলা গাজীপুর। অথচ রাজধানীর কাছের এই জেলাটির এইসব প্রাকৃতিক অঙ্গ এখন দখল-দূষণে প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বন উজাড়, শিল্প-কারখানার পানিতে নদী দূষণ, দখলে হুমকির মুখে গাজীপুরের পরিবেশ-প্রকৃতি। সচেতন গাজীপুরবাসী এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা তুলে ধরেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গাজীপুরের দুর্দশার চিত্র। একই সঙ্গে গাজীপুরের প্রকৃতি বাঁচাতে নদী দখল-দূষণ বন্ধ, বন উজাড় রোধ এবং কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জোর দাবি জানিয়েছেন।
গাজীপুরের শ্রীপুরে মাওনা এলাকার চকপাড়ায় আয়োজিত পাঠচক্র ও আলোচনা সভায় বক্তারা এসব বিষয়ে কথা বলেন।
চকপাড়ায় পল্লী উন্নয়নভিত্তিক পাঠাগার ‘পাঠইচ্ছা’র উঠানে শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে শুরু হয় নদী, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে পাঠচক্র ও আলোচনা সভা। এই আয়োজনে গাজীপুরের ১২ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
গাজীপুর মেরিডিয়ান স্কুলের শিক্ষার্থী নার্গিস সুলতানা বলেন, ‘আমাদের প্রাণের শহরটি ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী শিল্পায়িত এলাকায় পরিণত হয়েছে। তাই এই জনপদের অস্তিত্ব এখন অপরিণামদর্শী শিল্পায়নে হুমকির মুখে পড়েছে। এখন আমাদের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। কারখানার বর্জ্যপানি সরাসরি যাচ্ছে নদীগুলোতে, খালগুলো প্লাস্টিক-পলিথিনে ভরে উঠেছে।’
ভয়াবহ দূষণের কবলে শ্রীপুরের লবলং খালটি। এরকম খাল হয়ে দূষিত পানি গড়াচ্ছে নদীগুলোতে। কলেজ পড়ুয়া নিতু চৌধুরী বললেন নদী নিয়ে কত কবিতা আছে, মন ভাল কিংবা খারাপ, নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ নদীর পাড়ে যায় মন খুলে প্রাণজুড়ানো বাতাস পেতে। অথচ তার নদী নিয়ে কোনো সুখকর স্মৃতি নেই, বলার মতো কিছু নেই। দখলে নদী হারিয়েছে মায়াবী বাঁক, নদী এখন যাও বা আছে দূষণে-দুর্গন্ধে তার পাড়ে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর উপায় নেই।

আলোচনা সভায় গাজীপুরের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী বললেন, কেবল নদী নয় এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে গাজীপুরের প্রাকৃতিক সম্পদ শালবন। লোকমুখে শোনা যায় এই বনে বাঘ ছিল, ছিল হরিণ। এখন কিছু বানর দেখা যায়। কয়েকদিন আগে এক ময়লার ভাগাড়ের পাশে বানর মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে গাজীপুরের প্রকৃতির করুণ চিত্র চারপাশে ফুটে উঠছে।
নদী, পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা সভার প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রকৃতিবন্ধু মুকিত মজুমদার বাবু। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি গাজীপুরের প্রকৃতিসচেতন শিক্ষার্থীদের বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানান। প্রকৃতিকে ভালোবাসা একটি চর্চার বিষয়, এই ভালোবাসা থেকে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা সফল হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
নিজের শৈশবের স্মৃতিময় গাজীপুরের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার দেখা গাজীপুরের ছিলো অনেক গাছপালা, জলাশয়। এখানে আসলেই ভালো লাগতো। এখন এখানে যে পরিমাণ শিল্প-কারখানা হয়েছে তাতে গাজীপুর বদলে গেছে, অনেক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। জলাশয়গুলো কলুষিত হয়ে গেছে। শিল্পের কঠিন ও তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে! অথচ নদী ভাল না থাকলে পরিবেশ-প্রকৃতি ভালো থাকবে না। নদী রক্ষায় নদী পরিব্রাজক দলসহ একাধিক সংগঠন গাজীপুরের সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে, আশা করি তারা এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন।’
নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতি সংরক্ষণে সচেতন করে চলা মুকিত মজুমদার বলেন, ‘সীমাহীন লোভের শিকার হচ্ছে প্রকৃতি। অথচ প্রকৃতি ভালো না থাকলে আমরা ভালো থাকবো না। আমরা অনেক সমস্যার কথা শুনলাম। হতাশার মধ্যেও কাজ করে যেতে হবে। কারণ দেশ আমাদের, দেশটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রকৃতি রক্ষায়, পরিবেশ দূষণ রোধ এবং নদী বাঁচাতে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য সংগঠন হাতেহাত মিলিয়ে কাজ করে যাবে।’
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘প্রকৃতি বাঁচাতে হলে প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। আমরা একটা স্লোগান মনে রাখি, সেটা হলো জানো যদি, বাঁচবে নদী। জানার জায়গাটিতে আমাদের পরিসংখ্যান ও হালনাগাদ তথ্যটাও লাগবে। বর্তমানে সরকারিভাবে আমাদের নদী আছে ১১৫৬ টি, অনেক শিক্ষার্থীর হালনাগাদ এই তথ্যটি জানা নেই, আমাদের গাজীপুরে সর্বশেষ তথ্যমতে নদী আছে ১৯টি। তোমরা জানলেই প্রকৃতি-নদী রক্ষায় একেবারে জনগণ পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তোলা সহজ হবে।’
নদী, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে এই পাঠচক্র ও আলোচনা সভার আগে ১২টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এছাড়াও আলোচনা পর্বের ফাঁকে ছিল গাজীপুর নিয়ে বাংলার লোকজ ঐহিত্যবাহী পুঁথিপাঠ। এই আয়োজনে গাজীপুরের নদী রক্ষায় সক্রিয় থাকাদের শ্রেষ্ঠ নদীযোদ্ধা সম্মাননা দেয়া হয়।
এই পাঠচক্র ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের প্রকৃতি ও জীবন ক্লাব এবং পল্লী উন্নয়নভিত্তিক পাঠাগার ‘পাঠইচ্ছা’। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতিজন লিয়াকত চৌধুরী, বন,পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহমুদ হাসান।
সম্পূর্ণ আয়োজনের উদ্বোধক হিসেবে ছিলেন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অসীম বিভাকর, বিশেষ অতিথি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক (লাইসেন্সিং অথোরিটি) ড. সেলিম রেজা এবং বিশেষ আলোচক হিসেবে ছিলেন পিয়ার আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার বিভাগের প্রধান আহাম্মাদুল কবীর।
আলোচনা সভার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন নদী পরিব্রাজক দল শ্রীপুর শাখার সভাপতি সাঈদ চৌধুরী।