বাতাসে মৃদু দোল খেয়ে কাশবনের মঞ্জরি দল প্রথমেই বলে দেয় শরৎ এসেছে। শিশিরের শব্দের মতো শিউলি ফুল ঝরে শরতের জন্য বিলাপ করে। এদের সাথে পাল্লা দিয়ে পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছাদিত জলাভূমি ঐক্য প্রকাশ করে চিনিয়ে দেয় শরতের চিরকালীন রূপ। শরৎ যেন এক মায়াময়তায় স্নেহছায়ায় আচ্ছাদিত প্রেয়সীর শাড়ির আঁচল। শরতে সাদা মেঘের ফাঁকে ভূ-মণ্ডলের সীমানাহীন নীল আকাশ ফাঁকি দিয়ে কাশবনে নেমে পড়ে। নদী তীরের কাশফুল যেন সেই মায়াময় শরতে হৃদয় হরণকারী রূপের এক ভুবন। শরৎকালে ভাদ্র-আশ্বিনের এই শুভ্র রূপ সবই প্রকৃতির শুভ্রতার প্রতীক। কাশফুলের দুলুনি ছাড়া যেন শরৎ প্রকৃতি অসম্পূর্ণ। মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া ঘ্রাণহীন কাশফুল প্রকৃতিতে শুধুই মুগ্ধতা ছড়ায়। বর্ণিল পাঁপড়ি নেই, মৌ মৌ গন্ধ নেই! তবুও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানে শরতের কাশফুল। একরাশ সাদা পালকেই হৃদয় টানে, হাজারো প্রেমিকের নয়নের দৃষ্টি কাড়ে। অজানা এক ভালোলাগা অনুভবের হৃদয় টানে নিয়ে যায় কাশফুল।

ঝকঝকে নীল আকাশ। জলের ঢেউয়ে মৃদু বাতাস দোলা দিচ্ছে, সেই দোলা গিয়ে লাগছে নরম কোমল সাদাতুলো কাশফুলে। এই তো রূপসী বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি। চারদিকে কাশফুল আর কাশফুল। রাত এলেই তাদের উপর খসে পড়েছে আকাশের ঝলমলে তারা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঝাঁক বেঁধে স্বপ্ন বেঁধে কাশফুল কুড়োতে তেপান্তরে নেমে পড়ে। তারা শাপলার মতো পাল্লা দিয়ে কাশফুলে মালা গাঁথতে পারে না। তবে কিশোরীর হাতভর্তি কাশফুলের ভাঙা ঝাটিই মনে সুখ এনে দেয়।
স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, প্রভাতে আলোছায়ার খেলা, দিনভর এইসব মিলেই শরতের উম্মাদনা। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় প্রকৃতির অসাধারণ শিল্প! জলহারা শুভ্র মেঘের ভেলা নীলাকাশে ভাসে। নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে স্বপ্নলোকে উড়ে যায় আমাদের মন। এই মনভোলানো প্রকৃতিতে কাশফুলের কাছে মন কী যে চায়, তাই যেন বলে যাই। বোঝা বড়ই মুশকিল! রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলায় হৃদয়ে জমে মেঘমাল্য। মন কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক স্বপ্ন দ্যুতি। হৃদয়ের আকাঙ্খায় শরতের রঙে সাজাতে চায় মানব মন। হারিয়ে যাই- শরতের কাশফুলে গোধূলিবেলায় নদীর কিণারায়। একাকীত্বে সাথে আছে শিউলি গাছতলা। সন্ধ্যা রাতে জ্যোৎস্নার মাঝে কাশফুল স্পর্শে অনুভব করি প্রিয়ার স্নিগ্ধতা।
অযত্ন অবহেলায় অগোচরে প্রকৃতির এক সৌন্দর্যময়ী রাণী কাশফুল। কাশফুল ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। সবুজ চিরলপাতার ফাঁকে ফাঁকে সাদা পেখমের কাশফুল। নরম পালকের ন্যায় ধবধবে সাদা কাশফুল পাতার ফাঁকে বাতাসের দোলায় নুইয়ে পড়ে। কখনো দূর থেকে দূরে বাতাসে ভর করে উড়ে বেড়ায় ফুলের পালক। চোখ জুড়ানো মন ভোলানো কাশফুল তুলোর মতো ক্ষুদ্র ডালপালায় ভর্তি থাকে কাশফুল। চিকন পাতাগুলো খসখসে ধারালো হলেও কাশফুলগুলো নরম এবং কোমল। তাতেই তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে নদীর ঘাটে, পুকুর পাড়ে, বিলের পাড়ে। সাদা তুলোর মতোই তুলতুলে এই গন্ধহীন ফুল। নদীর বালুকাময় তীরেই কাশফুল বেশি শোভা পায়। নদীর অস্তগামী বহমান জল আর শ্বেতশুভ্র কাশবন দেখতে খুবই চমৎকার। কাশফুলের বন্দনায়ে প্রেম ও বিরহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন; ‘কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি।’

কাশফুল যেন তার শুভ্রতায় মনের কালিমা দূর করে। কাশবনের আঙিনায় কে যেন আমাদের টানে। প্রকৃতির কাশফুলের অদৃশ্য বাঁধনে আমরা গাঁথা পড়ি। ছুটে যাই, নয়ানে জড়িয়ে নেই স্বপ্নলোকে গাঁথা সাদা মালা। কাশফুল মানব প্রেমীদের অন্তরের তৃষ্ণা মেটায়। সাদা কেশর দুলিয়ে শরতের কাশফুল সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে নারী হৃদয় কাছে টানে।
ঘাসজাতীয় ফুলের মাঝে বাঙালি নারীর এমন হৃদয় অর্পণ চোখে পড়ে না। তোমার যে কোনো সৌরভ নেই। তোমায় দিয়ে কোনো মালা গাঁথা যায় না। প্রিয়তমাকে গুচ্ছবাঁধা ফুলের তোরাও নও তুমি! ক্ষণিকের ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার মতো ফুলও নও তুমি! চঞ্চল চপলা প্রিয়ার খোঁপায় গোঁজে থাকার সাধ্য হয় না তোমার। তবু তুমি দিগন্তছোঁয়া কাশফুল নীলের ঐ মনোরম তুলোর মেঘমালা হয়ে সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখো। গোধূলিবেলায় বিরহে মগ্ন করে রাখো। তাই নয়নে বেঁধেছি প্রিয়তীর জন্য কাশফুলের মালা! তবে কালের পরিক্রমায় দূষণ আর নদীবিলীন শরতে তোমার অপরূপ মাধুর্য নিয়ে সাদা মেঘেদের মতো মিছিল হয় না। তবু রূপসী বাংলার এই ঋতুচক্রে বর্ণিল শরতের দোলযাত্রায় উদ্ভাসিত হও শুভ্র কাশফুল!
মাসুদুর রহমান 



















