১৯৬০-এর দশকে, ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নোংরা পানির দেশের মধ্যে একটি ছিল সুইজারল্যান্ড। আর এখন? সুইজারল্যান্ডের শহরগুলোর গর্ব তাদের স্বচ্ছ নদী আর হ্রদের সৌন্দর্য।
বসন্তের শুরুতেই লেক জেনেভার চারপাশে ছায়াময় গাছের সারির সাজানো বহর দেখতে মানুষ ভিড় করে।
৭৫ বছর বয়সী রেনে রটেনবার্গ তাঁর ৪০০ মিটার সাঁতার শেষ করেছেন এই ব্যস্ত শহরের মাঝে—যা তিনি সপ্তাহে পাঁচবার পর্যন্ত করেন। রটেনবার্গ ‘লে জিভ্রে’ সাঁতার ক্লাবের একজন সদস্য।
দাঁতের ডাক্তার, সেক্রেটারি, বিচারক, শিক্ষক এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, দুপুরের বিরতিতে সাহস করে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডা পানিতে ঝাঁপ দেয়। ঠান্ডায় লালচে হয়ে বেরিয়ে আসে তারা।
“এখানে সবাইকে পাওয়া যায়,” বলেন রটেনবার্গ। সাঁতারের পর একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে, তারপর আবার ফিরে যায় শহরের ব্যস্ততায়।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক স্থানে শহরের মাঝখানে নদীতে মানুষ সাঁতার কাটে —এমন দৃশ্য ভাবাই যায় না। ২০২৪ সালে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিকের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনের তিন-চতুর্থাংশ নদী বেশ খারাপ অবস্থায় আছে।
পানিজাতীয় সংস্থার বর্জ্য এবং কৃষিজ বিষাক্ততা এই দূষণের প্রধান কারণ, যার ফলে বিষাক্ত শৈবাল জন্ম নিচ্ছে, মাছ মারা যাচ্ছে, এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডে ১৯৬০-এর দশকে নদী ও হ্রদগুলো ছিল ময়লা, ফেনা, আবর্জনা আর মরা মাছের ভাসমান আস্তানা। আরে নদী, লিমাত নদীতে সাঁতার ছিল স্বাস্থ্যগত কারণে নিষিদ্ধ। পানি গিলে ফেললে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তো।
১৯৬৫ সালে মাত্র ১৪% মানুষ বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্রে সংযুক্ত ছিলো। কিন্তু আজ, সেটা ৯৮%-এ পৌঁছেছে।
আজকে সুইজারল্যান্ড “নীল সোনা” নামে খ্যাত তার স্বচ্ছ পানির জন্য — যার কৃতিত্ব জটিল নেটওয়ার্কের স্যুয়ারেজ প্ল্যান্টগুলোর।
এই রূপান্তরের একটি মূল কারণ ছিল ১৯৬৩ সালে জেরমাট শহরে টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব। এতে তিনজন মারা যায়, ৪৩৭ জন অসুস্থ হয়।
সৈন্য মোতায়েন হয়, স্কুলে তৈরি হয় অস্থায়ী হাসপাতাল। এরপর জনগণের চাপ আসে পানির উৎস পরিষ্কার করার জন্য। ১৯৭১ সালে, সুইস আইন অনুযায়ী বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা হয়।
আজ সুইজারল্যান্ডের নদীগুলো ইউরোপে সবচেয়ে পরিষ্কার হিসেবে পরিচিত। ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থার ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ১৯৬টি সাঁতারের উপযুক্ত এলাকার মধ্যে, মাত্র ৫টি স্থান নিম্ন মানের।
“পরিষ্কার পানি সুইস জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন মাইকেল ম্যাটল, পানি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান হোলিঞ্জারের প্রধান। “আমরা প্রচণ্ড সতর্কতা অবলম্বন করি যেন পানি দূষিত না হয়।”

এর জন্য অর্থ তারা ব্যয় করতেও প্রস্তুত। ২০২২ সালে একজন নাগরিকের পেছনে গড়ে ১৭৪ পাউন্ড খরচ করেছে সুইস সরকার, যেখানে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০ পাউন্ড।
“মানুষ জানে না পানিকে পরিষ্কার করতে কত পরিশ্রম লেগেছে, কিন্তু তারা এটার গুরুত্ব বোঝে,” বলেন ম্যাটল। “আমার মনে হয় সুইসরা তাদের পানিকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ এটা তাদের একটি ‘সুস্থ ও আনন্দময় জীবন’ উপহার দেয়।”
লেক জেনেভার পাড়ে শুধু সাঁতারুরাই নয়—কেউ বই পড়ছে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, শিশুরা পাথরের ওপর থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে।
“আমরা পানির ভালোবাসায় একত্রিত,” বলেন লে জিভ্রে সাঁতার ক্লাবের সদস্য পাস্কাল বোডিন। অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি প্রতিদিন এখানে আসেন। কাজ ছাড়ার পর এই সাঁতার ক্লাব তার জন্য অন্যতম একটি সামাজিক মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“যদি বন্ধুই না থাকে, সামাজিক জীবন না থাকে, তবে মানুষ ঘরে আটকে পড়ে, বিষণ্ণতায় ভোগে। এখানে আছে তার সেরা ওষুধ, ঠান্ডা পানি আর বন্ধুত্ব।”