পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার ভাবনা

পরিবেশ রক্ষায় সব কিছুর আগে জনগণের চেতনা জাগ্রত করার জোরালো আহ্বান   

পরিবেশ রক্ষায় সব কিছুর আগে জনগণের চেতনা জাগ্রত করার জোরালো আহ্বান   

দেশে নানাখাতে সংস্কারে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও পরিবেশ বিষয়ক কোনো সংস্কার কমিশন বা এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, দেশের মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থেই এমন পদক্ষেপ দরকার ছিল। এমন পদক্ষেপের অভাব থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের আয়োজনে হয়ে গেল পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার ভাবনা শীর্ষক একটি আলোচনা সভা। যেখানে পরিবেশ উপদেষ্টা, পরিবেশকর্মী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা সবাই একটি বিষয়ে জোরালোভাবে একমত হয়েছেন, আর সেটি হলো: সব কিছুর আগে পরিবেশ রক্ষা যে কতটা জরুরী সেই বোধ জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলা।

 

বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে আজ রোববার (১ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় বক্তারা এই একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশ বিষয়ে নিজ নিজ সংস্কার ভাবনা তুলে ধরেন।

সভায় প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জোর দিয়ে বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষেরই পরিবেশসচেতন হওয়া জরুরি।’

 

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “শুধু রাস্তা, ফ্লাইওভার বা বিদ্যুৎই জীবনের মূল চাহিদা হতে পারে না। যদি বাতাস ও পানি দূষিত হয়, তবে বিদ্যুৎ দিয়ে সবকিছু ঠিক রাখা সম্ভব নয়। ফুসফুসে ক্যান্সার হয় এমন বাতাসে বিদ্যুৎ দিয়ে কী করবেন? বাতাস পরিশোধনের জন্য পর্যাপ্ত গাছ না থাকলে রাস্তা দিয়ে কী হবে?”

 

ইটভাটা বন্ধ, হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব মোকাবিলা, সিসিটিভি স্থাপনসহ নানা কার্যক্রমে বাজেট ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি লোকবল সংকটে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের শূন্য পদ পূরণ ও জমি সংক্রান্ত আইন সংস্কারের ওপর জোর দেন।

 

তিনি আরও বলেন, “পাহাড় কাটা, বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধে রাতেও পাহারা ও প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং চালুর জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শক্তিশালী করতে হবে।”

 

আলোচনা সভায় পরিবেশ সচেতনতার কাজ করে যাওয়া গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। আলোচনার সঞ্চালক তাঁর কাছে পরিবেশ রক্ষায় গণমাধ্যমের করণীয় নিয়ে সংস্কার ভাবনা উত্থাপনের আহ্বান জানান।

 

২০১০ সাল থেকে সম্প্রচার হতে থাকা প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানের মূল কারিগর তাঁর দেয়া বক্তব্যে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমে বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দেন।

প্রকৃতিবন্ধু বলেন, ‘গণমাধ্যমে আমরা পরিবেশ-প্রকৃতিকে যতোটা জোর দেবো ততোই আমাদের সাধারণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বাড়বে। পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য আজ নানা সংকটে, এই সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা হতে পারে সচেতনতা গড়ার মূল চালিকাশক্তি। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ে দূষণের উৎস এবং বন নিধনের প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যম পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা-তথ্য, পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত কার্যকর উপায়ে প্রচার করবে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে সরকারি নানা নীতি-প্রকল্পের সমালোচনাও যেন মুক্তভাবে করা যায়, গণমাধ্যমের জন্য সেই স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। ’

 

তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যম যেন পরিবেশ বিষয়ে জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে, এর মাধ্যমে যেন নীতিনির্ধারকদের ওপর জনস্বার্থ রক্ষার চাপ সৃষ্টি হয়। দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, বন নিধন, নদী দখলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যেন বেশি বেশি প্রকাশিত হয়। এছাড়া পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো তুলে ধরে ইতিবাচক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজটিও গণমাধ্যম করতে পারে। সাংবাদিকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেক সময় পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’

 

সবুজপ্রেমী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘৭১ সালে আমরা মাত্র সাড়ে ৭ কোটি লোক ছিলাম, আজ ১৮-২০ কোটি লোক। দেশটা বড় হয়নি। পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর এই বিপুল জনসংখ্যার যে ব্যাপক চাপ তা মাথায় রাখতে হবে, সে অনুযায়ী কর্মসূচী নিতে হবে এবং এজন্য গণমাধ্যমকে সঙ্গে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো দেশটা আমাদের, একে ভালো রাখার দায়িত্ব সবার। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখে।’

 

দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে চলা এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরিবেশ রক্ষায় আরও দু’টি বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, ‘যতোই সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলি না কেন, দেশীয় বাস্তবতায় পরিবেশ রক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগ খুব বেশি দরকার। আবার আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তরের লোকবলের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই এবার যে বাজেট আসছে তাতে যেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর জন্য যথেষ্ট বরাদ্দের প্রত্যাশা করি।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. খন্দকার রাশেদুল হক তাঁর  বক্তব্যে যেকোনো সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-পারিবারিক পর্যায়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেন। পরিবেশ অধিদপ্তরে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সদিচ্ছা নিয়ে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কর্মস্পৃহা দিয়ে সংকট উত্তরণের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, কেবল শাস্তি দিয়ে পরিবেশ রক্ষা হয় না, সবার আগে দরকার নাগরিকদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক চেতনা জাগ্রত করা। এছাড়া তিনি পরিবেশ দূষণ সরেজমিনে পরিদর্শন এবং সব মন্ত্রণালয়ে পরিবেশ কর্মকর্তার পদ রাখারও প্রস্তাব করেন।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদারকে পরিবেশ সচেতনতায় সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে বলার আহ্বান জানানোয় তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের অবস্থা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করেন। শহরের বায়ু ও শব্দদূষণে তথাকথিত শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন মানুষদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি অন্তত একটি বড় সংস্কারের প্রস্তাব করেন। সেটি হলো- শহরের স্কুল-কলেজগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়িতে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেয়ার সংস্কৃতি বদলানো।

 

তাঁর মতে, স্কুল সময়ে এই গাড়িগুলো রাস্তায় সৃষ্টি করে ব্যাপক যানজট, যাতে দূষিত হয় নগরীর বাতাস, অহেতুক হর্ন বাজানোয় হয় শব্দদূষণ এবং দীর্ঘক্ষণ জটে আটকা গাড়িগুলো বাড়ায় উত্তাপ। তাই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাস চালু বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া সময়ের সঙ্গে পরিবেশ আইন সংস্কারেরও প্রস্তাব করেন তিনি।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো. শামীম। তিনি দেশে পরিবেশগত সংকট যেমন- পানি, বায়ু, শব্দ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। একই সঙ্গে সিসা দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন উজাড়, ভূমিক্ষয় এবং ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনগত বিপর্যয়কর চিত্র উপস্থাপন করেন। এসব সংকট মোকাবেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল সংকট, গবেষণার অভাবও উঠে আসে তার উপস্থাপিত পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে।

 

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম, বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ, ওয়েস্ট কনসার্ন-এর নির্বাহী পরিচালক আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা ও বেলা’র ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর বারিস চৌধুরী।

আপলোডকারীর তথ্য

Shuvo

পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার ভাবনা

পরিবেশ রক্ষায় সব কিছুর আগে জনগণের চেতনা জাগ্রত করার জোরালো আহ্বান   

আপডেট সময় ০৬:৪৬:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

দেশে নানাখাতে সংস্কারে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও পরিবেশ বিষয়ক কোনো সংস্কার কমিশন বা এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, দেশের মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থেই এমন পদক্ষেপ দরকার ছিল। এমন পদক্ষেপের অভাব থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের আয়োজনে হয়ে গেল পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার ভাবনা শীর্ষক একটি আলোচনা সভা। যেখানে পরিবেশ উপদেষ্টা, পরিবেশকর্মী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা সবাই একটি বিষয়ে জোরালোভাবে একমত হয়েছেন, আর সেটি হলো: সব কিছুর আগে পরিবেশ রক্ষা যে কতটা জরুরী সেই বোধ জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলা।

 

বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে আজ রোববার (১ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় বক্তারা এই একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশ বিষয়ে নিজ নিজ সংস্কার ভাবনা তুলে ধরেন।

সভায় প্রধান অতিথি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জোর দিয়ে বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষেরই পরিবেশসচেতন হওয়া জরুরি।’

 

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “শুধু রাস্তা, ফ্লাইওভার বা বিদ্যুৎই জীবনের মূল চাহিদা হতে পারে না। যদি বাতাস ও পানি দূষিত হয়, তবে বিদ্যুৎ দিয়ে সবকিছু ঠিক রাখা সম্ভব নয়। ফুসফুসে ক্যান্সার হয় এমন বাতাসে বিদ্যুৎ দিয়ে কী করবেন? বাতাস পরিশোধনের জন্য পর্যাপ্ত গাছ না থাকলে রাস্তা দিয়ে কী হবে?”

 

ইটভাটা বন্ধ, হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব মোকাবিলা, সিসিটিভি স্থাপনসহ নানা কার্যক্রমে বাজেট ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি লোকবল সংকটে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের শূন্য পদ পূরণ ও জমি সংক্রান্ত আইন সংস্কারের ওপর জোর দেন।

 

তিনি আরও বলেন, “পাহাড় কাটা, বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধে রাতেও পাহারা ও প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং চালুর জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট শক্তিশালী করতে হবে।”

 

আলোচনা সভায় পরিবেশ সচেতনতার কাজ করে যাওয়া গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। আলোচনার সঞ্চালক তাঁর কাছে পরিবেশ রক্ষায় গণমাধ্যমের করণীয় নিয়ে সংস্কার ভাবনা উত্থাপনের আহ্বান জানান।

 

২০১০ সাল থেকে সম্প্রচার হতে থাকা প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানের মূল কারিগর তাঁর দেয়া বক্তব্যে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমে বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দেন।

প্রকৃতিবন্ধু বলেন, ‘গণমাধ্যমে আমরা পরিবেশ-প্রকৃতিকে যতোটা জোর দেবো ততোই আমাদের সাধারণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বাড়বে। পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য আজ নানা সংকটে, এই সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা হতে পারে সচেতনতা গড়ার মূল চালিকাশক্তি। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ে দূষণের উৎস এবং বন নিধনের প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যম পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা-তথ্য, পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত কার্যকর উপায়ে প্রচার করবে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে সরকারি নানা নীতি-প্রকল্পের সমালোচনাও যেন মুক্তভাবে করা যায়, গণমাধ্যমের জন্য সেই স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। ’

 

তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যম যেন পরিবেশ বিষয়ে জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে, এর মাধ্যমে যেন নীতিনির্ধারকদের ওপর জনস্বার্থ রক্ষার চাপ সৃষ্টি হয়। দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, বন নিধন, নদী দখলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যেন বেশি বেশি প্রকাশিত হয়। এছাড়া পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো তুলে ধরে ইতিবাচক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজটিও গণমাধ্যম করতে পারে। সাংবাদিকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেক সময় পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’

 

সবুজপ্রেমী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘৭১ সালে আমরা মাত্র সাড়ে ৭ কোটি লোক ছিলাম, আজ ১৮-২০ কোটি লোক। দেশটা বড় হয়নি। পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর এই বিপুল জনসংখ্যার যে ব্যাপক চাপ তা মাথায় রাখতে হবে, সে অনুযায়ী কর্মসূচী নিতে হবে এবং এজন্য গণমাধ্যমকে সঙ্গে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো দেশটা আমাদের, একে ভালো রাখার দায়িত্ব সবার। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখে।’

 

দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে চলা এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরিবেশ রক্ষায় আরও দু’টি বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, ‘যতোই সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলি না কেন, দেশীয় বাস্তবতায় পরিবেশ রক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগ খুব বেশি দরকার। আবার আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তরের লোকবলের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই এবার যে বাজেট আসছে তাতে যেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর জন্য যথেষ্ট বরাদ্দের প্রত্যাশা করি।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. খন্দকার রাশেদুল হক তাঁর  বক্তব্যে যেকোনো সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-পারিবারিক পর্যায়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেন। পরিবেশ অধিদপ্তরে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সদিচ্ছা নিয়ে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কর্মস্পৃহা দিয়ে সংকট উত্তরণের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, কেবল শাস্তি দিয়ে পরিবেশ রক্ষা হয় না, সবার আগে দরকার নাগরিকদের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক চেতনা জাগ্রত করা। এছাড়া তিনি পরিবেশ দূষণ সরেজমিনে পরিদর্শন এবং সব মন্ত্রণালয়ে পরিবেশ কর্মকর্তার পদ রাখারও প্রস্তাব করেন।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদারকে পরিবেশ সচেতনতায় সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে বলার আহ্বান জানানোয় তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের অবস্থা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করেন। শহরের বায়ু ও শব্দদূষণে তথাকথিত শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন মানুষদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি অন্তত একটি বড় সংস্কারের প্রস্তাব করেন। সেটি হলো- শহরের স্কুল-কলেজগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়িতে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেয়ার সংস্কৃতি বদলানো।

 

তাঁর মতে, স্কুল সময়ে এই গাড়িগুলো রাস্তায় সৃষ্টি করে ব্যাপক যানজট, যাতে দূষিত হয় নগরীর বাতাস, অহেতুক হর্ন বাজানোয় হয় শব্দদূষণ এবং দীর্ঘক্ষণ জটে আটকা গাড়িগুলো বাড়ায় উত্তাপ। তাই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাস চালু বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া সময়ের সঙ্গে পরিবেশ আইন সংস্কারেরও প্রস্তাব করেন তিনি।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো. শামীম। তিনি দেশে পরিবেশগত সংকট যেমন- পানি, বায়ু, শব্দ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। একই সঙ্গে সিসা দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন উজাড়, ভূমিক্ষয় এবং ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনগত বিপর্যয়কর চিত্র উপস্থাপন করেন। এসব সংকট মোকাবেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল সংকট, গবেষণার অভাবও উঠে আসে তার উপস্থাপিত পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে।

 

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম, বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ, ওয়েস্ট কনসার্ন-এর নির্বাহী পরিচালক আবু হাসনাত মো. মাকসুদ সিনহা ও বেলা’র ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর বারিস চৌধুরী।