বিশ্বজুড়ে যখন পরিবেশ বিপর্যয় আর জলবায়ু পরিবর্তনের অশনি সংকেত, ঠিক সেই সময়ে এক বাঙালি যোদ্ধার নিরলস প্রচেষ্টা বৈশ্বিক মনোযোগ কেড়েছে। তিনি মুকিত মজুমদার বাবু, একাধারে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সফল উদ্যোক্তা, ইমপ্রেস গ্রুপ ও চ্যানেল আই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক—তবে যিনি বিশ্বমঞ্চে পরিচিত তাঁর ‘প্রকৃতিবন্ধু’ পরিচয়ে। তাঁর কাজ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার এক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে।
পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এক মহৎ মিশন
ব্যবসার শীর্ষ অবস্থান বা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের পরিচিতির বাইরে মুকিত মজুমদার বাবুর আসল পরিচয় হলো তিনি প্রকৃতির এক নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। তাঁর ভেতরের এই গভীর টান কেবল আবেগ নয়, জন্মভূমির প্রতি এক আজন্ম দায়বদ্ধতা। তিনি মনে করেন, নতুন প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত, সুস্থ ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এক বাংলাদেশ গড়া কেবল স্বপ্ন নয়, এটি এক পবিত্র দায়িত্ব। এই দর্শনই তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একজন অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান দিয়েছে। তাঁর হৃদয় প্রকৃতির স্পন্দনে মিশে যাওয়া এক সুরের মতো, যা কেবল সৌন্দর্য নয়, বিলুপ্তির শঙ্কাকেও অনুভব করে নিরন্তর।

‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’: যেখানে স্বপ্ন ছোঁয় বিশ্বকে
মুকিত মজুমদার বাবুর সবুজ স্বপ্নের মূর্ত প্রতীক হলো ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশন শুধু বাংলাদেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে না, এটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলা ও অভিযোজন সম্পর্কিত গণসচেতনতা সৃষ্টিতে এক বৈশ্বিক মডেল হিসেবে কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী উদ্যোগ হলো তাঁর পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনায় চ্যানেল আই-এর ধারাবাহিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন’—যা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করেছে। এই অনুষ্ঠানটি এখন বাংলাভাষী দর্শকদের জন্য প্রকৃতির এক প্রামাণিক দলিল, যা প্রকৃতিপ্রেম জাগিয়ে তুলতে এবং প্রকৃতি রক্ষার শপথকে বিশ্বজুড়ে শাণিত করতে সহায়ক।

বহুমাত্রিক উদ্যোগ: বিরল প্রাণের সুরক্ষায় অবিরাম সংগ্রাম
মুকিত মজুমদার বাবুর প্রকৃতি রক্ষার উদ্যোগ কোনো একক মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বহুমাত্রিক এবং সুদূরপ্রসারী। তাঁর এই সংগ্রামে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল দিকটি হলো বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিরল ও মহাবিপন্ন প্রাণী, পাখি ও উদ্ভিদের জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন।
মহাবিপন্ন প্রাণের রক্ষক
তিনি শুধু সংরক্ষণ নয়, অবমুক্তকরণের মাধ্যমে প্রাণীজগতকে তাদের আপন গৃহে ফিরিয়ে দেওয়ার এক মহৎ কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত। বিশেষ করে, মহাবিপন্ন ‘বড় কাইট্টা কাছিম’ এবং পরিবেশের ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত ‘শকুন’-এর মতো প্রজাতিদের অবমুক্তকরণ ও সংরক্ষণে তাঁর কাজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই সংগ্রাম কেবল কিছু প্রাণীকে বাঁচানো নয়, বরং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার এক মানবিক অঙ্গীকার।
পাখ-পাখালির প্রতি গভীর টান
তাঁর মনোযোগ বিশেষত সেইসব পাখ-পাখালির দিকে, যাদের কলতান আমাদের প্রকৃতি থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। মুকিত মজুমদার বাবু পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে অবিরাম কাজ করছেন। তাঁর উদ্যোগে পরিচালিত ‘পাখিশুমারি’ প্রমাণ করে, তিনি কেবল মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন না, বরং প্রকৃতির ভাষাকে গভীরভাবে অনুধাবন করছেন। এই পাখিশুমারির মাধ্যমে বিপন্ন প্রজাতির পাখিদের তালিকা তৈরি এবং তাদের নিরাপদ বিচরণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তিনি অক্লান্তভাবে লড়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ‘প্রজাপতি পার্ক’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষুদ্রতম প্রাণীটিও কীভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্যে অপরিহার্য।

গবেষণা ও জনসচেতনতার আলোকবর্তিকা
তিনি জাতীয় দৈনিকে ‘প্রকৃতি ও জীবন’ নামে পূর্ণাঙ্গ পাক্ষিক পাতা সম্পাদনা এবং ‘প্রকৃতিবার্তা’ নামে ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে প্রকৃতি-বিষয়ক গবেষণাধর্মী কাজকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রকৃতিবিষয়ক গ্রন্থসমূহ এখন পরিবেশ সচেতনতার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
সচেতনতা সৃষ্টি ও সম্মাননা
তৃণমূল পর্যায়ে প্রকৃতি মেলার আয়োজন, ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক’ প্রদান এবং স্কুল প্রোগ্রাম—এই সবকিছুই সাধারণ মানুষকে প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে গড়ে তোলার এক অনন্য প্রচেষ্টা। পরিবেশ সুরক্ষায় তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুকিত মজুমদার বাবু ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ অর্জন করেছে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক-২০১২, ২০১৫’ সহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা।
মুকিত মজুমদার বাবু শুধুমাত্র প্রকৃতির বন্ধু নন, তিনি প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ এক বৈশ্বিক সাহসী সৈনিক, যিনি ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ছেড়ে বিলুপ্তির মুখে থাকা প্রাণের জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের প্রকৃতিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে এক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা পৃথিবীর যেকোনো পরিবেশবাদী আন্দোলনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তিনি দেখিয়েছেন, উদ্যোগ আর ভালোবাসার শক্তি দিয়ে কীভাবে একজন মানুষ তার জাতির সবুজ ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে পারে—তাঁর এই সংগ্রাম প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক গভীর নাড়া দেয়।
এটিএম সামসুজ্জোহা 



















