বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মনজুরুল কিবরীয়াকে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক-২০২৩ প্রদান করা হয়েছে।
আজ বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আইয়ের “চেতনা চত্বরে” অধ্যাপক ড. মো: মনজুরুল কিবরীয়ার হাতে এ পদক তুলে দেওয়া হয়। পদক তুলে দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ, বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী, সুইডেন দূতাবাসের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মারটিনেজ বেকস্ট্রম এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ইমপ্রেস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু প্রমুখ।
প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক ২০২৩ প্রদান করায় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন ও চ্যানেল আই কে ধন্যবাদ জানিয়ে অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, আমার পেশা হচ্ছে শিক্ষিকতা, আমি একজন গবেষক কিন্তু আমি নদী নিয়ে কাজ করি মূলত তিনটি কারনে।
প্রথমত সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমি হালদা পাড়ের সন্তান। হালদা পাড়ের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে আমি নদী নিয়ে কাজ করি। দ্বিতীয়ত শিক্ষাগত দায়বদ্ধতা, আমি যেহেতু প্রাণিবিদ্যা ফিশারীজ নিয়ে পড়াশুনা করেছি, রাষ্ট্র আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। রাষ্ট্রকেও আমার কিছু দেওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত নৈতিক দায়বদ্ধতা, আমি নদী নিয়ে কাজ করি, নদী দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে কাজ করি। তিনি বলেন আমরা এমন কোনো কাজ করতে পারি, যে কাজের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড ইবাদতে রূপান্তর করতে পারি। হালদা নদীর ১৮ কোটি লিটার পানির মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের ৭০/৮০ লক্ষ মানুষ জীবন নির্বাহ করে। যদি একটি নদীকে আমি সংরক্ষণ করতে পারি, জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড ইবাদতে রূপান্তর করতে পারি।
নদী রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশকে যদি সংরক্ষণ করতে হয়, নদী সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের নদী রক্ষায় গবেষণার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরিতে প্রায় দুই দশক ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রথিতযশা নদী গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে বিএসসি (সম্মান), একই বিভাগের লিমনোলজি অ্যান্ড ফিশারিজ বায়োলজি শাখা থেকে ১৯৯৬ সালে এমএসসি এবং ২০১৬ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া তার কর্মজীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে। হালদা নদীকে কেন্দ্র করে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে ড. কিবরীয়ার একান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় নদীভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। এই প্রতিষ্ঠানে আছে বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি, নদী জাদুঘর ও আর্কাইভ এবং ডিজিটাল কনফারেন্স সেন্টার। ড. কিবরীয়া হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে হালদা নদীতে ডলফিন শুমারি ও ডলফিন মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে বাংলাদেশে প্রথম ডলফিনের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।
হালদা নদীর মা-মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া সাফল্য পেয়েছেন, যা দেশের সার্বিক মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ড. কিবরীয়া নদী নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি নদী সংরক্ষণে বহুমুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এসবের মধ্যে অন্যতম অর্জন পাঠ্য বইয়ে হালদা নদীর অন্তর্ভুক্তি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়ার প্রায় অর্ধশতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০টি আন্তর্জাতিক সেমিনারসহ প্রায় শতাধিক সেমিনারে অংশ নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত আছেন।
নদী রক্ষায় গবেষণার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় পরিবেশ পদক, বেস্ট রিভার সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী পুরস্কার, দ্য ম্যানথান অ্যাওয়ার্ড সাউথ এশিয়া, চট্টগ্রামের অহংকার সম্মাননা ও উজ্জ্বল অগ্রণী সম্মাননা।
প্রকৃতি সংরক্ষণে ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালের ১ আগস্ট চ্যানেল আইয়ে শুরু হয় নতুন মাত্রার গবেষণা, তথ্যবহুল, সচেতনতা ও শিক্ষামূলক ধারাবাহিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘প্রকৃতি ও জীবন’। প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক প্রদান শুরু হয় ২০১১ সালে। গবেষণা, জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে নানা কাজ করে যাচ্ছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।