সংবাদ শিরোনাম ::
Logo ইকোসিস্টেমকে রক্ষা করে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুরক্ষার বার্তা দিলেন পরিবেশ সচিব Logo নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে এবছরের ‘সবুজে সাজাই বাংলাদেশ’ শুরু  Logo গাজীপুরে কৃষি প্রযুক্তি ও পুষ্টি মেলার উদ্বোধন Logo দাবি না মানলে জবি শিক্ষার্থীদের লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা Logo সাম্য হত্যার ঘটনায় শোক পালন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন Logo অ্যান্টার্কটিকায় জলবায়ু পরিবর্তন স্পষ্ট, পূর্ব দিকের চেয়ে পশ্চিমে দ্রুত গলছে বরফ Logo প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন হলে সে উন্নয়ন টেকসই হবেনা: রিজওয়ানা হাসান Logo ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি দিলো চবি Logo চিরতরে চলে গেলেন ‘সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট’   Logo চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড: প্রধান উপদেষ্টা

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে

বাঁশি একই সাথে পেশা এবং সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে উঠেছে। সংগীতে বাঁশি অপরিহার্য উপাদান। বাঁশি সংগীতকে করে তোলে শ্রুতিমধুর এবং হৃদয়গ্রাহী। বাঁশির করুণ সুরের টানে বিরহিনী প্রিয়ার প্রাণ করে আনচান। বাঙালি সংস্কৃতির বাঁশি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এটি ছাড়া সংগীত যেন জমে উঠে না। প্রতিবছর পহেলা বর্ষবরণেও ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়ে যায়। বাঁশি নিয়ে অনেকের কৌতূহল আছে। কিন্তু এটি সবাই বাজাতে পারে না। বিশেষ কলাকৌশলে অনুশীলনে এটি রপ্ত করতে হয়। এটি তৈরি করতেও বিশেষ কারিগর দরকার পড়ে। আমাদের দেশে বাঁশি তৈরির জন্য একটি গ্রাম প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। গ্রামটি সম্পর্কে জানার আগে আমরা বাঁশি সম্পর্কে একটু জেনে নেই।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশি বা বাঁশরী হল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাপ্ত এক ধরনের বাদ্যযন্ত্রবিশেষ। বাঁশি এক ধরনের সুষির অর্থাৎ ফুৎকার দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র। কাঠের তৈরি রিড বিশিষ্ট বায়ুচালিত বাদ্যযন্ত্রের বাইরে গিয়ে বাঁশি একটি এয়ারোফোন বা রিড বিহীন বায়ুচালিত যন্ত্র বলা যেতে পারে। বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ’টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। বেশকিছু বাঁশিতে দুই প্রান্ত খোলা থাকে, একপ্রান্তে ফুৎকার করতে হয় এবং উপর দিকে থাকা ফুটো গুলির মাধ্যমে ওঠে। প্রথাগত বাঁশির গঠনে কোনো পর্দা বা চাবির ব্যবহার নেই, বাদক তাঁর ইচ্ছেমতো ছিদ্রগুলোকে আঙুল দিয়ে চেপে বন্ধ করে কিংবা খোলা রেখে নানান সুর সৃষ্টি করতে পারেন। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাংলায় বাঁশি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ বংশী  থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বাঁশি নামটিও এসেছে বাঁশ থেকে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

এবার বাঁশির গ্রাম সম্পর্কে জেনে নেই। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাঁশের বাঁশির গ্রাম শ্রীমদ্দি। কুমিল্লার হোমনা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিমি দূরে তিতাস নদীর পাশে অবস্থিত শ্রীমদ্দি গ্রাম। হোমনার উল্লেখযোগ্য নদী  তিতাস ও মেঘনা। একসময় কাঠালিয়া নদী ছিল খরস্রোতা কিন্তু আজ সেটি শান্ত। তিতাস  নদীর মাধ্যমে হোমনা বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ভাগ হয়েছে। শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি পল্লিতে বর্ষবরণের শেষ সময়ের ব্যস্ততম সময় পার করছেন বাঁশির কারিগররা। কারণ কয়েকদিন পরেই বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে। শ্রীমদ্দি গ্রাম ‘বাঁশির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। আর নববর্ষ মানেই বৈশাখী মেলা। আর বৈশাখী মেলা মানেই বাঁশির কদর একটু বেশিই। তাই শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশিপল্লিতে তৈরি হচ্ছে নানান রকমের বাঁশি। মেলায় বাঁশির জোগান দিতে ব্যস্ত পল্লির সবাই। বৈশাখ ঘনিয়ে এলেই শ্রীমদ্দি গ্রামের কারুশিল্পীদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। নববর্ষকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশিশিল্পীরা।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার বাঁশি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাঁশি বাণিজ্যের মাধ্যমে দ্রুত পাল্টে গেছে গ্রামের দৃশ্যপট। বাঁশি তৈরি করে এখানকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। শুধু তাই নয়, এখান থেকে বছরে কোটি টাকার বাঁশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা ও অলি-গলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি। নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষই বাঁশি তৈরিতে দক্ষ। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় মার্কেটগুলোতে। চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, মিরসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে ট্রাকযোগে শ্রীমদ্দি গ্রামে নিয়ে আসেন কারিগররা। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাঁশ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর টুকরোগুলো রোদে শুকিয়ে মাপ অনুযায়ী ছিদ্র করা হয়। পরে বাঁশের গায়ের রং দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়। বাঁশি শিল্লীদের তৈরি প্রতি পিস মোহন বাঁশি ১৫ টাকা, আড় বাঁশি ২০ টাকা, মুখ বাঁশি ৮ টাকা, নাগিনী বাঁশি ১০ টাকা, ক্যালেনের বাঁশি ১২ টাকা, পাখী বাঁশি ২০ টাকা, সোহন বাঁশি ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। তবে লম্বা, মোটা ও নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশির মধ্যে তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আর বাঁশি (ক্লাসিক্যাল সুরের বাঁশি), বীণ বাঁশি, বেলুন বাঁশি রয়েছে। বিদেশের অনেক দেশেই বাঁশির কদর অনেক বেশি। কারণ এ বাঁশি একেবারেই প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব। আমাদের দেশে বংশীবাদকের কাছে খানদানি বাঁশির কদর অনেক বেশি। তবে লম্বা, মোটা নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে। এই বাঁশি বিভিন্ন এনজিও এক্সপোর্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, লন্ডন, জাপান, কানাডা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন। বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ীর মেলা, কচুয়ার রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা, নাঙ্গলবন্দের স্নানোৎসব, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়া লালন উৎসব, গাজীপুরের মৌসুমী মেলায় সবচেয়ে বেশি বাঁশি বিক্রি হয়ে থাকে। তা ছাড়া সারা বছরই দেশের শহর-বন্দর, হাট-বাজারে তাদের বাঁশি বিক্রি করে থাকে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি রং, কয়লা, স্প্রিটসহ বাঁশি তৈরির সব উপকরণের দামই বেড়েছে। কিন্তু বাঁশির দাম আগের মতোই রয়েছে। ফলে কারিগরদের লাভ কমছে। একশ থেকে দেড়শ বছর ধরে চলছে এই গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ। বর্তমানে পূর্বসূরিদের দেখানো পথে এখনো অন্তত অর্ধশতাধিক পরিবার বাংলার ঐতিহ্য লালন করতে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাঁশি তৈরির কাজ। এই গ্রামের অনেক পরিবার সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং সরকারের সহযোগিতা চায়। এটি তাদের জীবন-জীবীকার একমাত্র পথ। বেঁচে থাকুক তাদের পেশা এবং আমাদের সংস্কৃতির অপূর্ব উপাদান প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এই বাঁশি। শ্রীমদ্দি গ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য এ বাঁশি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

আপলোডকারীর তথ্য

ইকোসিস্টেমকে রক্ষা করে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুরক্ষার বার্তা দিলেন পরিবেশ সচিব

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে

আপডেট সময় ০৫:২১:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫

বাঁশি একই সাথে পেশা এবং সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে উঠেছে। সংগীতে বাঁশি অপরিহার্য উপাদান। বাঁশি সংগীতকে করে তোলে শ্রুতিমধুর এবং হৃদয়গ্রাহী। বাঁশির করুণ সুরের টানে বিরহিনী প্রিয়ার প্রাণ করে আনচান। বাঙালি সংস্কৃতির বাঁশি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। এটি ছাড়া সংগীত যেন জমে উঠে না। প্রতিবছর পহেলা বর্ষবরণেও ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়ে যায়। বাঁশি নিয়ে অনেকের কৌতূহল আছে। কিন্তু এটি সবাই বাজাতে পারে না। বিশেষ কলাকৌশলে অনুশীলনে এটি রপ্ত করতে হয়। এটি তৈরি করতেও বিশেষ কারিগর দরকার পড়ে। আমাদের দেশে বাঁশি তৈরির জন্য একটি গ্রাম প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। গ্রামটি সম্পর্কে জানার আগে আমরা বাঁশি সম্পর্কে একটু জেনে নেই।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশি বা বাঁশরী হল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাপ্ত এক ধরনের বাদ্যযন্ত্রবিশেষ। বাঁশি এক ধরনের সুষির অর্থাৎ ফুৎকার দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র। কাঠের তৈরি রিড বিশিষ্ট বায়ুচালিত বাদ্যযন্ত্রের বাইরে গিয়ে বাঁশি একটি এয়ারোফোন বা রিড বিহীন বায়ুচালিত যন্ত্র বলা যেতে পারে। বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ’টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়। বেশকিছু বাঁশিতে দুই প্রান্ত খোলা থাকে, একপ্রান্তে ফুৎকার করতে হয় এবং উপর দিকে থাকা ফুটো গুলির মাধ্যমে ওঠে। প্রথাগত বাঁশির গঠনে কোনো পর্দা বা চাবির ব্যবহার নেই, বাদক তাঁর ইচ্ছেমতো ছিদ্রগুলোকে আঙুল দিয়ে চেপে বন্ধ করে কিংবা খোলা রেখে নানান সুর সৃষ্টি করতে পারেন। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়। বাংলায় বাঁশি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ বংশী  থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বাঁশি নামটিও এসেছে বাঁশ থেকে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

এবার বাঁশির গ্রাম সম্পর্কে জেনে নেই। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাঁশের বাঁশির গ্রাম শ্রীমদ্দি। কুমিল্লার হোমনা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিমি দূরে তিতাস নদীর পাশে অবস্থিত শ্রীমদ্দি গ্রাম। হোমনার উল্লেখযোগ্য নদী  তিতাস ও মেঘনা। একসময় কাঠালিয়া নদী ছিল খরস্রোতা কিন্তু আজ সেটি শান্ত। তিতাস  নদীর মাধ্যমে হোমনা বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ভাগ হয়েছে। শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি পল্লিতে বর্ষবরণের শেষ সময়ের ব্যস্ততম সময় পার করছেন বাঁশির কারিগররা। কারণ কয়েকদিন পরেই বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে। শ্রীমদ্দি গ্রাম ‘বাঁশির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। আর নববর্ষ মানেই বৈশাখী মেলা। আর বৈশাখী মেলা মানেই বাঁশির কদর একটু বেশিই। তাই শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশিপল্লিতে তৈরি হচ্ছে নানান রকমের বাঁশি। মেলায় বাঁশির জোগান দিতে ব্যস্ত পল্লির সবাই। বৈশাখ ঘনিয়ে এলেই শ্রীমদ্দি গ্রামের কারুশিল্পীদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। নববর্ষকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশিশিল্পীরা।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার বাঁশি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাঁশি বাণিজ্যের মাধ্যমে দ্রুত পাল্টে গেছে গ্রামের দৃশ্যপট। বাঁশি তৈরি করে এখানকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। শুধু তাই নয়, এখান থেকে বছরে কোটি টাকার বাঁশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা ও অলি-গলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি। নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষই বাঁশি তৈরিতে দক্ষ। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি চলে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় মার্কেটগুলোতে। চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, মিরসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে ট্রাকযোগে শ্রীমদ্দি গ্রামে নিয়ে আসেন কারিগররা। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাঁশ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর টুকরোগুলো রোদে শুকিয়ে মাপ অনুযায়ী ছিদ্র করা হয়। পরে বাঁশের গায়ের রং দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়। বাঁশি শিল্লীদের তৈরি প্রতি পিস মোহন বাঁশি ১৫ টাকা, আড় বাঁশি ২০ টাকা, মুখ বাঁশি ৮ টাকা, নাগিনী বাঁশি ১০ টাকা, ক্যালেনের বাঁশি ১২ টাকা, পাখী বাঁশি ২০ টাকা, সোহন বাঁশি ১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। তবে লম্বা, মোটা ও নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশির মধ্যে তোতা (মুখ) বাঁশি, মোহন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, খানদানি বাঁশি, আর বাঁশি (ক্লাসিক্যাল সুরের বাঁশি), বীণ বাঁশি, বেলুন বাঁশি রয়েছে। বিদেশের অনেক দেশেই বাঁশির কদর অনেক বেশি। কারণ এ বাঁশি একেবারেই প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব। আমাদের দেশে বংশীবাদকের কাছে খানদানি বাঁশির কদর অনেক বেশি। তবে লম্বা, মোটা নিখুঁত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে। এই বাঁশি বিভিন্ন এনজিও এক্সপোর্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, লন্ডন, জাপান, কানাডা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন। বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ীর মেলা, কচুয়ার রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা, নাঙ্গলবন্দের স্নানোৎসব, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়া লালন উৎসব, গাজীপুরের মৌসুমী মেলায় সবচেয়ে বেশি বাঁশি বিক্রি হয়ে থাকে। তা ছাড়া সারা বছরই দেশের শহর-বন্দর, হাট-বাজারে তাদের বাঁশি বিক্রি করে থাকে।

বর্ষবরণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের বাঁশি তৈরির ধুম পড়েছে prokritibarta

বাঁশের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি রং, কয়লা, স্প্রিটসহ বাঁশি তৈরির সব উপকরণের দামই বেড়েছে। কিন্তু বাঁশির দাম আগের মতোই রয়েছে। ফলে কারিগরদের লাভ কমছে। একশ থেকে দেড়শ বছর ধরে চলছে এই গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ। বর্তমানে পূর্বসূরিদের দেখানো পথে এখনো অন্তত অর্ধশতাধিক পরিবার বাংলার ঐতিহ্য লালন করতে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাঁশি তৈরির কাজ। এই গ্রামের অনেক পরিবার সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং সরকারের সহযোগিতা চায়। এটি তাদের জীবন-জীবীকার একমাত্র পথ। বেঁচে থাকুক তাদের পেশা এবং আমাদের সংস্কৃতির অপূর্ব উপাদান প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এই বাঁশি। শ্রীমদ্দি গ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য এ বাঁশি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।