গত সোমবার দেশের বিভিন্ন জেলায় কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে বজ্রপাত ঘটে। এতে প্রাণ যায় অন্তত ১০ জনের। এর মধ্যে কুমিল্লার বরুড়ায় ২ জন, মুরাদনগরে ২ জন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে ২ জন ও মিঠামইনে একজন, সুনামগঞ্জের শাল্লায় একজন, নেত্রকোনার কলমাকান্দায় একজন ও মদনে একজন রয়েছেন। এবছর দেশে বজ্রাঘাতে শুরুতেই প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মের শুরুতে এবারও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর খবর আসছে। সেই সঙ্গে ঘটছে বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি। দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোয় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ!
বজ্রপাতের কারণ কী?
বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ। তার মতে, ‘বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম ও আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুইটা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।’ তিনি বলেন, ‘শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয়। আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়। এ রকম উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায়, তাতেই আঘাত করে।’
বজ্রপাতের মাত্রা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনা করে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার এটিকে বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, ভারতের কয়েকটি অংশে এবং নেপালেও বজ্রপাত হয়। তবে এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। দেশের আয়তনের তুলনায় হতাহতের সংখ্যাও বেশি। এর কারণ হিসাবে সচেতনতার অভাবও দায়ী। ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালে বজ্রপাত হলেও সেখানে মৃত্যুর হার এত বেশি নয়। আবহাওয়াবিদদের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এ পরিস্থিতির তৈরি হয়। যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়, সেখান থেকেই বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। গবেষকগণ বলেন, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ তার মধ্যে দক্ষিণ-এশিয়া অন্যতম।
উন্নত দেশগুলোতে বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু কমলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সংখ্যা বাড়ছে। বন্যা এবং সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি অনেকটা ভূমিকম্পের মতোই আকস্মিক। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে ভেনিজুয়েলা এবং ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে তাদের অচেতনতা এর কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর বেশি শিকার হন খোলা মাঠে কাজ করা কৃষক বা জেলেরা। বিশেষ করে হাওড়াঞ্চলে খোলা জায়গায় মানুষজন কাজ করার কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার কারণেও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে।
বজ্রাঘাত থেকে যেভাবে রক্ষা পাবেন
বজ্রপাত প্রতিবছর বাংলাদেশে বহু মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি করছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, বজ্রপাতের সময়সীমা সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেজন্য ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের সময় নিরাপদ থাকার জন্য কিছু নির্র্দেশিকা প্রকাশ করেছে।
বজ্রপাতের সময় সতর্কতামূলক কিছু নির্র্দেশিকা
বজ্রপাতের সময় ঘরের ভেতরে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। জানালা ও দরজা বন্ধ রাখুন, যাতে বজ্রপাতের তীব্র শব্দ ও বৈদ্যুতিক প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটি পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নিতে পারলে। খোলা মাঠ, হাওর, নদী বা পুকুরের কাছে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসুন। গ্রামের মাঠে অবস্থান করলে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ান। তারপর কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসুন। বজ্রপাতের সময় এভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে বা উঁচু স্থানে দাঁড়াবেন না, কারণ গাছ ও উঁচু স্থান বজ্রপাতের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছগুলোতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই ওই স্থানে আশ্রয় নেবেন না। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর থাকুন। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করে অনেক মানুষ আহত হয়েছে। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি, ফ্রিজ বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন। মোবাইল ফোন ব্যবহার না করাই ভালো, তবে ওয়্যারলেস বা কর্ডলেস ডিভাইস ব্যবহার করা যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে থাকলে সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। গাড়ির কাচেও হাত দেবেন না। ধাতব খুঁটি, টাওয়ার, তার বা যেকোনো ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকুন। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যান। বাড়ির ছাদ বা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যান। বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সরে পড়ুন। পানি খুব বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ। আপনার বাড়িতে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। এজন্য আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও সতর্কতা
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর নিয়মিত বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। তাদের সতর্কবার্তা অনুসরণ করে আপনি বিপদ এড়াতে পারেন। মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশের পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ জমলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসময় মানুষকে নিরাপদ স্থানে অবস্থানের পরামর্শ দেন। প্রাণহানি কমাতে এ বিষয়ক জনসচেতনার উপরে জোর দেন আবহাওয়াবিদরা। বজ্রধ্বনি শুনবেন যখন, ঘরে যাবেন তখন। এ প্রতিপাদ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ দেন তারা। যদি জরুরি প্রয়োজন থাকে তাহলে রাবারের জুতা পরে বের হতে পারেন।
বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসা
বজ্রপাতে আক্রান্ত হলেই তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণত মারা যায় না। কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকের মত আহতদের চিকিৎসা করতে হবে। কোন ব্যক্তির উপরে বজ্রপাত হলে তার শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। ফলে হৃৎপিন্ড বন্ধ হয়ে যায়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাবেন। একইসঙ্গে বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদি আহত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড সচল থাকে তাহলে তাকে সাথে সাথে সিপিআর (Cardiopulmonary resuscitation, কার্ডিওপালমোনারি পুনরুজ্জীবিতকরণ) দিতে হবে। সেজন্য সিপিআর সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে ধরার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। কারণ আহত কিংবা মৃত ব্যক্তির শরীরে বিদ্যুৎ থাকে না। এ বিষয়ে প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখুন।
মনে রাখবেন বজ্রপাত একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। বজ্রপাতের সময় নিরাপদ স্থানে অবস্থান করুন এবং পরিবারের সদস্যদেরও সতর্ক করুন। সতর্ক থাকুন, নিরাপদ থাকুন।