আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজার দিন। হিন্দু ধর্মে সরস্বতী জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যার্জনের দেবী। কিন্তু সনাতনধর্মী আদিতে সরস্বতী এবং প্রকৃতি ছিল নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ সরস্বতী দেবীর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বেশ গভীর।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হল জলবতী অর্থাৎ নদী। পুরাণে বলা হয়েছে-দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বৃদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা প্রভৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যার কারণে এর প্রতীক হিসেবে সরস্বতীর হাতে শোভা পাচ্ছে বীণা।
নামের সঙ্গে জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্য ছিল। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। যার চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার।
সনাতনধর্মজ্ঞানীদের ব্যাখ্যানুযায়ী, সরস্বতীর রূপ দু’টি-নদীরূপী সরস্বতী ও বিদ্যা দেবীরূপী সরস্বতী। নদীরূপী সরস্বতীর বুকে অসংখ্য হাঁস বিচরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। সরস্বতীর বাহনও হাঁস, রাজহাঁস। কেন?
একটা যুক্তি এই যে, হাঁস জলমেশানো দুধ থেকে দুধটা আলাদা করে পান করতে পারে। অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে ছেঁকে নেওয়াই তো আসল শিক্ষা, তাই সরস্বতী হংসবাহিনী।
কিন্তু কখনও আবার তিনি ময়ূরাসীনা। কী তার অর্থ? ময়ূর অহঙ্কারী, নিজের রূপের মোহে নিজেই আবিষ্ট। তাকে বাহন করে সরস্বতী শিক্ষা দেন: বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। অর্থাৎ বিনয়ের।
পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবী হিসেবে পরিচিতা। পরবর্তীকালে বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি কেবলমাত্র বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
প্রাগৈতিহাসিককালে মানুষের কোনো ধর্ম বা দেবদেবী কিছুই ছিল না। ইতিহাস বই-এর ভাষায় এ হল প্রস্তর যুগের কথা। তখন ছিল নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার যুগ। তারপর মানুষ যত স্থিত হয়েছে, নিজেরাই খাদ্য, বস্ত্র তৈরি করে জীবন কিছুটা সহজ করতে পেরেছে, তাদের চারপাশ দেখার অবকাশ হল, তারা দেখল, প্রাত্যহিক জীবনে অনেক প্রাকৃতিক সহায়তা তারা পেয়ে থাকে। কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও বা ভয়ে তারা নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে মর্যাদা দিল। প্রকৃতির বিভিন্ন অংশ- জল, বায়ু, মাটি, আলো থেকে শুরু করে গাছ, ফুল, পশু, পাখিদের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক রূপে আরাধনা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সময়ের পথচলার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত আরাধ্য শক্তিগুলি চেহারা, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট বদল হতে থাকে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচিত এবং উপাসিত হতে হতে বদলে যেতে থাকে তাঁদের চেহারা, বাহন, আসন এবং ক্ষমতা। সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের এবং দেবদেবীদের ধারণার বিবর্তনও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়!