প্রজাপতি অনেকেরই পছন্দের প্রাণীর তালিকায় পড়ে, বিশেষ করে শিল্প ও কবিতায় এদের কদর অনেক বেশি। অনেকে একে সৌভাগ্যের প্রতীকও মনে করে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি এক জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই দশকে প্রজাপতির সংখ্যা প্রায় এক পঞ্চমাংশ কমে গিয়েছে।
প্রায় ৭৬,০০০ এরও বেশি আঞ্চলিক জরিপের উপর ভিত্তি করে দেখা গিয়েছে যে, ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রজাপতি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।
বিংহ্যামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী এলিজা গ্রেইমস এর মতে, “এতো কম সময়ে এতো বেশি হারে প্রজাপতি হারিয়ে যাওয়াটা সত্যিই অনেক হতাশাজনক। এটি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। মানুষ প্রজাপতি ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”
গবেষণায় আরো দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রজাপতির সংখ্যা হ্রাসের যে হার, তার সাথে বৈশ্বিক কীটপতঙ্গের গড় হ্রাসের হারের মিল পাওয়া যায়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্নস্থানে জরিপ করে দেখা যায় যে, কীটপতঙ্গের হার প্রতি বছরে প্রায় ১% থেকে ২% হারে কমছে।
পোকামাকড়ের বিলুপ্তির এই সংকট, আমাদের বাস্তুসংস্থানের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফসল পরাগায়নের জন্য প্রজাপতি, মৌমাছির মতো পরাগবাহী কীটপতঙ্গের উপর নির্ভরশীল।
নতুন এই গবেষণায় ৩০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী কাজ করেছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় প্রজাপতির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে, বিশদ আকারে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই গবেষণায় ৩৪০টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সেখান থেকে তাদের জনসংখ্যার প্রবণতা নিয়ে ধারণা নেওয়া হয়েছে।
যদিও এই গবেষণা থেকে প্রজাপতির সংখ্যা হ্রাসের নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায় নি। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, অধিকহারে কীটনাশকের ব্যবহার, যত্রতত্র বাসস্থান ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত প্রজাপতির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও, আলোক দূষণের কারণে জোনাকি ও পতঙ্গের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রজাপতিদের জন্য হুমকির কারণগুলো অঞ্চলভেদে একটু ভিন্ন হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমের শুষ্ক কিছু এলাকায়, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে খরা আরও তীব্র হচ্ছে। এতে করে প্রজাপতিগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে এবং তাদের আশ্রয়ের গাছগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, মধ্য-পশ্চিম দিকের অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক এলাকাগুলোয় কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে প্রজাপতির মৃত্যুর হার বাড়ছে।
কীটপতঙ্গের এই অকাল মৃত্যু মানবজাতির জন্য গুরুতর পরিণতি বয়ে আনছে। কিন্তু অনেকেই তা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন না। তবে প্রজাপতি সেক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম।
স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিতভাবে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি তৈরি করতে সাহায্য করে। এছাড়াও তারা মনার্ক প্রজাপতিদের বাঁচাতে মিল্কউইড রোপণ করে থাকে।
এই মনার্ক প্রজাপতি তাদের উজ্জ্বল রঙ ও দীর্ঘ দূরত্বের অভিবাসনের জন্য খ্যাত। কিন্তু গত বছরই প্রথমবারের মতো, এই প্রজাপতি যুক্তরাষ্ট্রে বিপন্ন তালিকাভুক্ত হয়েছে।
এলিজা গ্রেইমস আরো বলেছেন, “মানুষের মনে প্রজাপতিদের জন্য এক ধরণের মমত্ববোধ কাজ করে, যা তারা অন্যান্য কীটপতঙ্গের জন্য খুব একটা অনুভব করে না। যদি একজন সাধারণ মানুষ জানতে পারেন যে, নিজের বাসার উঠোনে ছোটখাটো কিছু কাজ দিয়েই প্রজাপতিদের সাহায্য করতে পারবেন, তাহলে তিনি সেটা অবশ্যই করবেন। এটি আমাদের পুরো বাস্তুতন্ত্রের কল্যাণের কথা চিন্তা করার একটা পথ করে দেয়।”
গ্রেইমস মনে করেন, প্রজাপতিদের বাঁচাতে বাসস্থান পুনরুদ্ধার করতে হবে, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং কীটপতঙ্গকে শুধু কীট নয়, বরং মূল্যবান বন্যপ্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
গ্রেইমস এর মতে, “প্রজাপতিরা মৌমাছির মতো পরাগায়নে এতোটা কার্যকর নয়। তারা ঘাসফড়িংয়ের মতো পুষ্টি চক্রে অনেক বড় ভূমিকাও রাখে না, কিন্তু তবুও তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাপতি আমাদের শিল্প ও সাহিত্যে অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হই। এই প্রাণীগুলোর প্রতি সংযোগের অনুভূতি, আমাদের চারপাশের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ অনুভব করতে সাহায্য করে।”
তবে কিছু প্রজাপতি হয়তো নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে কিছু প্রজাতির সংখ্যা ৯৫% বা তার বেশি হ্রাস পেয়েছে। ফ্লোরিডা হোয়াইট নামে একটি প্রজাতি, গত ২০ বছরে জরিপের তালিকা থেকে একদম হারিয়ে গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় প্রজাপতি গবেষক আর্ট শ্যাপিরো – তিনি গত কয়েক দশক ধরে একই এলাকায় প্রজাপতির সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করছেন। শ্যাপিরো বলেন, “একসময় ভাবতেও পারিনি যে প্রজাপতিরাও ডাইনোসর বা ডোডো পাখির মতো বিলুপ্তির পথে যেতে পারে। এখন আমার বয়স ৭৯। ভাবছি – আমি আগে বিদায় নেব, নাকি এরা? এটা মোটেও সুখকর কোনো চিন্তা নয়।”