কেটো কচ্ছপ, কাইট্টা কচ্ছপ বা বোদো কাছিম , আন্তর্জাতিক পরিচয় নর্দান রিভার ট্যারাপিন। যার বৈজ্ঞানিক নাম:বাটাগুর বাসকা। একপ্রজাতির নদীমাতৃক কচ্ছপ। এটি মিঠা ও নোনা দুই ধরনের পানিতেই বাস করতে পারে। এই ক্ষমতা অন্য কোনো কচ্ছপের নেই। হাল্কা চোখা নাক, ঈষৎ জলপাই বর্ণের দেহ, মায়াভরা মুখ প্রাণীটির।
২০০০ সালের দিকে বন্যপ্রাণী গবেষকরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে আর বাটাগুর বাসকার কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০০৮ সালে গবেষকরা প্রকৃতিতে বাটাগুর বাসকা আছে কি না তা খুঁজতে শুরু করেন। এরপর নোয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন জলাশয়ে আটটি বাটাগুর বাসকা পাওয়া যায়। শুরু হয়ে যায় মহাবিপন্ন বাটাগুর বাসকা রক্ষার মিশন, বন বিভাগের চেষ্টায় যোগ দেয় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
সেই মিশনে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া বড় কাইট্টা বা বাটাগুর বাসকা কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজননের উদ্যোগে বড় ধরণের সফলতার আসায়, এর সংরক্ষণ ও প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনতে আরও দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে, বন বিভাগ, অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনা এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিএনের মহাবিপন্নের তালিকায় থাকা বাটাগুর বাসকা সংরক্ষণ ও মুক্ত প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনতে ২০১২ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে, বন বিভাগ, অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনা এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
সুন্দরবনের করমজলের বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র ও গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে নিবিড় পরিচর্যায় বর্তমানে বাটাগুর বাসকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫শ’।
বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানান, বাটাগুর বাসকা কচ্ছপের এমন এক প্রজাতি যা বিরল হয়ে গেছে। একে সংরক্ষণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। এই সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গবেষণায় এগিয়ে এসেছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনে, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ভিয়েনা জু।
বন বিভাগ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং ভিয়েনা জু বাটাগুর বাসকা সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় সাফল্য পেয়েছে। সাফল্য অক্ষুণ্ণ রাখতে ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই ৩ পক্ষ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের করমজলে সংরক্ষিত অবস্থায় বাটাগুর বাসকা আছে, প্রজনন হচ্ছে। সুন্দরবনের আরও প্রায় ১৬ টি পুকুরে আমরা বাটাগুর বাসকা ছেড়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাটাগুর বাসকার প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজনন করে সুন্দরবন এলাকায় ছড়িয়ে যাবে। এভাবেই বাটাগুর বাসকা আবার প্রকৃতিতে ফিরে আসবে।’
কচ্ছপটি সংরক্ষণ ও প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনার অভিযাত্রায় আরও ২ বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে সংস্থাগুলো। বিপন্ন প্রজাতির এই কচ্ছপ ফিরিয়ে আনার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার সঙ্গী প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
আবারও এই প্রচেষ্টার অংশ হয়ে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘বাটাগুর বাসকা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। গবেষণা ও আন্তরিকতায় প্রাণীটি আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে। ক্যাপটিভ অবস্থায় আশা জাগানো সংখ্যায় বাটাগুর বাসকার প্রজনন হয়েছে।’
প্রকৃতিবন্ধু আরও বলেন, ‘বাটাগুর বাসকার প্রায় ৫’শ বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। এখন আমরা যে কাজটি করতে চাইছি তা হলো, এই বাচ্চাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সক্ষম বিবেচনায় আমরা অবমুক্ত করবো, রেডিও ট্রান্সমিটার লাগানো প্রাণীগুলোর হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে তারা প্রজনন সঙ্গী পাচ্ছে কিনা, কোথায় যাচ্ছে, কোথায় ডিম দিচ্ছেসহ সার্বিক গতিবিধি জীবনাচরণ নিয়ে তথ্য পাবো। এর মাধ্যমে এই মহাবিপন্ন প্রাণীটির সংরক্ষণ প্রচেষ্টা সফল হবে বলে আশা করি।’
এক সময় সুন্দরবন থেকে শুরু করে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া উপকূল পর্যন্ত ছিলো বাটাগুর বাসকার বসতি। অনিয়ন্ত্রিত মাছ শিকার, সচেতনতার অভাব, বাসস্থান ধ্বংস, অতিমাত্রায় শিকার, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণে বাটাগুর বাসকা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি-আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় বাটাগুর আবার ফিরবে বাংলার প্রকৃতিতে এই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।