বিজ্ঞান কখনো কখনো এমন কিছু আবিষ্কার করে যা শুধু জ্ঞান বাড়ায় না, বরং মানুষের মানসিকতায় এক গভীর পরিবর্তন আনে। মহাবিশ্বের বিশালতা এবং তাতে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
এমনই একটি মুহূর্ত ছিল, যখন মহাকাশযান থেকে প্রথমবারের মতো, পৃথিবীর ছবি পাঠানো হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো অন্য কোনো গ্রহে জীবনের সম্ভাব্য চিহ্নের আবিষ্কার, যেমনটা সম্প্রতি ঘটেছে একটি গ্রহে।
K2-18b নামক এই গ্রহে এমন একটি গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীতে সাধারণ সামুদ্রিক প্রাণীরা উৎপাদন করে।
এই আবিষ্কারের নেতৃত্ব দেওয়া বিজ্ঞানীর মতে, সত্যিকারের এলিয়েন জীবনের সন্ধান এখন আর কল্পনার অতীত নয়।
“এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় ও মৌলিক প্রশ্নগুলোর একটি,” বলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিক্কু মাধুসূদন। “আমরা হয়তো এর উত্তরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।”
সত্যিই যদি অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে সেটা প্রজাতি হিসেবে আমাদেরকে কীভাবে বদলে দেবে?
আমাদের পূর্বপুরুষেরা আকাশে বসবাসকারী প্রাণীর কল্পনা বহু আগেই শুরু করেছিলেন।
বিশ শতকের শুরুতে, কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে সোজাসুজি রেখা দেখার দাবি করেছিলেন। এর ফলে মঙ্গলে উন্নত সভ্যতা থাকার ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে জন্ম নেয় অসংখ্য “ফ্লাইং সসার” ও সবুজ রঙের ছোট এলিয়েন ঘিরে সায়েন্স ফিকশন কল্পকাহিনির চর্চা।
এখন যেটা দেখে অন্য গ্রহে প্রাণের সন্ধানের “সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ” বলে ধরা হচ্ছে, সেটা মঙ্গল বা শুক্র থেকে আসে নি। এসেছে একটি দূরাগত নক্ষত্রের কক্ষপথে থাকা গ্রহ থেকে, যা পৃথিবী থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইল দূরে।
আজ পর্যন্ত প্রায় ৬,০০০ গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে আমাদের সৌরজগতের বাইরে। এর অনেকগুলোই বৃহস্পতি বা শনির মতো গ্যাসীয় দৈত্য, যেগুলো জীবনধারণের অনুপযোগী।
তবে কিছু গ্রহের দুরত্ব জীবনধারণের জন্য যথাযথ, যেগুলোর অবস্থানকে জ্যোতির্বিদরা “গোল্ডিলকস জোন” নাম দিয়েছেন।
অধ্যাপক মাধুসূদনের ধারণা, শুধু আমাদের গ্যালাক্সিতেই এমন হাজারো গ্রহ থাকতে পারে।
এইসব গ্রহ আবিষ্কারের পাশাপাশি, বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করার যন্ত্রও তৈরি করতে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তারার আলো যখন গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসে, তখন তার মধ্য দিয়ে বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক চিহ্ন খুঁজে বের করা। এগুলো শুধুমাত্র জীবেরাই তৈরি করতে পারে, ইংরেজিতে যাকে বলে “বায়ো-সিগনেচার।“
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST), যেটি K2-18b তে গ্যাস সনাক্ত করেছে, সেটি এখন পর্যন্ত তৈরিকৃত সবচেয়ে শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীন।
তবে এর সীমাবদ্ধতাও আছে। এটি পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহ বা খুব কাছের তারার পাশে থাকা গ্রহ শনাক্ত করতে পারে না।
এ জন্য নাসা ২০৩০-এর দশকে হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবজারভেটরি (HWO) চালু করতে যাচ্ছে। যা পৃথিবীর মতো গ্রহের বায়ুমণ্ডল শনাক্ত করতে এবং নমুনা সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
অধ্যাপক মাধুসূদন আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন, যে তিনি সত্যিই K2-18b গ্রহে জীবনের সম্ভাব্য চিহ্ন আবিষ্কার করেছেন।
তবে এটি নিশ্চিত হলে পুরো বিশ্বে উৎসবমুখর অবস্থা না-ও হতে পারে। বরং শুরু হতে পারে নতুন বৈজ্ঞানিক বিতর্ক, এই চিহ্ন কোনো জীবের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে।
প্রফেসর ডগার্টি মনে করেন, এমন আবিষ্কার বিজ্ঞান ও মানব আত্মার জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। “এমন কোনো প্রাণ থাকলে সেটা আমাদেরকে নিজের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।”
পূর্বে এরকম উৎসাহ নিয়ে অন্য গ্রহে প্রাণ খোঁজা হয়নি, আর আগে কখনো এত শক্তিশালী যন্ত্রও হাতে ছিল না। অনেক বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, এটি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। ‘যদি’ নয়, ‘কবে’ আমরা জীবনের চিহ্ন পাবো।
অধ্যাপক মাধুসূদনের মতে, এই আবিষ্কার আমাদেরকে কেবল ভয় নয়, বরং আশা এনে দেবে।
“যেদিন আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু নক্ষত্র বা গ্রহ নয়, বরং একটি জীবন্ত আকাশ দেখব, সেদিন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে। ভাষা, রাজনীতি, ভৌগোলিক বিভাজন সবই গলে যাবে। আমরা বুঝতে পারব, আমরা সবাই একই সত্তার অংশ এবং সেটা আমাদের আরও কাছে নিয়ে আসবে।“
“এটি হবে আমাদের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ।”