মাঙ্কিপক্স কী?
করোনার পর বিশ্বে যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে মাঙ্কিপক্স। কারণ এই রোগটি করোনার মতোই ছোঁয়াচে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ অনেকটা ফ্লুর মতো। রোগের একপর্যায়ে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয় এবং এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ভারতে ইতোমধ্যে চারজনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই রোগের প্রার্দুভাব দেখা যায় নি। তবে আমাদের আগে থেকেই সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত।
মাঙ্কিপক্স (MPXV) এমন একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। সংক্ষেপে একে এমপক্স বলে। মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ অনেকটাই স্মলপক্স বা গুটি বসন্তের মতো। গুটিবসন্তের একই গোত্রীয় ভাইরাস হলেও এমপক্স সাধারণত অনেক কম ক্ষতিকারক। প্রথমে এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা ‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর (সিডিসি) তথ্য অনুসারে, ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের এক গবেষণাগারে প্রথম বাঁদরের দেহে মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস চিহ্নিত হয়। ১৯৭০ সালে আফ্রিকার দেশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোয় মানবদেহে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এমপক্স এই মহাদেশের মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে বুরুন্ডি, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, সুইডেন, কেনিয়া ও পাকিস্তান। ২০২৩ সালের জানুয়ারির পর থেকে এখন পর্যন্ত কঙ্গোতে ২৭ হাজার মানুষের এমপক্স শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্ত ও মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই শিশু। এই মুহূর্তে এমপক্স ভাইরাসের কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে একটি ধরন বেশি বিপজ্জনক। ‘ক্লেড ১বি’ নামের ধরনটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে শনাক্ত হয়েছে। এই নিয়ে দু’বছরে দুইবার মাঙ্কিপক্স নিয়ে জরুরি অবস্থার ঘোষণা করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মাঙ্কিপক্স কতটা বিরল?
মানবদেহে স্মলপক্স যে ভাইরাস থেকে হয়, এটি সেই পরিবারের অন্তর্গত। এই অসুখটি খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী। কিন্তু চিকেনপক্স বা জলবসন্তের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ আরেকটি করোনা মহামারির মতো হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী মূল্যায়নে (ডব্লিউএইচও) এমনটাই জানিয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলেছে, এই ভাইরাস অজানা নয়, এটি সম্পর্কে অনেক বছর আগে থেকেই জানা আছে। এর অর্থ হলো ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সংস্থার এক কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এমপক্স নতুন আরেকটি কোভিড মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই, নতুন বা পুরোনো যে ধরণই হোক না কেন। কারণ, এ রোগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তা কর্তৃপক্ষের জানা আছে।
কোন ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে?
এই রোগে প্রথম পর্যায়ে ত্বকের উপর গুটি বেরোতে থাকে। তখন নরম টিস্যু ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের পর এনসেফেলাইটিস দেখা দিতে পারে। এনসেফালাইটিস হলো মস্তিষ্কের প্রদাহ। এই রোগ তীব্র হলে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও নিউমোনাইটিস যা ফুসফুসের টিস্যুর প্রদাহ হতে পারে। চোখ আক্রান্ত হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স কীভাবে ছড়ায়?
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তি বা পশুর সংস্পর্শে কেউ আসে তখনই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ তখনই ঘটে, যখন কারও ক্ষত, হাঁচিকাশি বা নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা জলকণা বা মুখের লালার সংস্পর্শে আসেন। ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমেও এই সংক্রমণ ঘটে। ভাইরাসটি ত্বক, কোষ, শ্বাসতন্ত্র, চোখ, নাক বা মুখের শ্লেষ্মা ঝিল্লির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। একবার সংক্রামিত হলে পরিবারের অপর সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। চিকিৎসার সময় হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের সংক্রমণের বিশেষ ঝুঁকি থাকে। বন্যপ্রাণী শিকারের মাংস ভক্ষণ, পশুর আঁচড়, কামড় এবং মুখের তরল থেকে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এসে কথা বলা বা শ্বাস নেয়ার মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এটি একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটি ক্ষত চামড়া, শ্বাসতন্ত্র, চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ভাইরাসে দূষিত হয়েছে এমন বিছানা, পোশাক এবং তোয়ালের সংস্পর্শের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। বানর, ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো কোনো সংক্রমিত প্রাণীর কাছাকাছি কেউ আসলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন।

মানুষ থেকে মানুষে কতটা সংক্রমণ ঘটাতে পারে?
মাঙ্কিপক্স এক ব্যক্তি থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হতে পারে, এমন সংক্রমণ তুলনায় কম ঘটে। মানুষ থেকে মানুষে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ সাধারণত লার্জ রেসপিরেটরি ড্রপলেট, অর্থাৎ নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা বড় আকারের জলকণা থেকে হয়ে থাকে। এই ধরনের জলকণা কয়েক ফুটের চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। তার ফলে, আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সময় মুখোমুখি সংস্পর্শে এসে থাকলে তবেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। মাঙ্কিপক্স সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ থাকে। উপসর্গ শুরু হওয়ার পর থেকে গুটিগুলি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে নতুন চামড়া তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়াতে পারে। উপসর্গহীন ব্যক্তির থেকে অন্যদের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে না।
কী ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে বুঝবেন আপনি আক্রান্ত
মাথাব্যথা, জ্বর, পিঠে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, কাঁপুনি, ক্লান্তি, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া (লিম্ফ নোড রোগ প্রতিরোধক্ষমতার একটি অঙ্গ, বাংলায় একে লসিকা গ্রন্থি বলে) ইত্যাদি এসব প্রাথমিক উপসর্গ দিয়ে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ শুরু হয়। গুটিবসন্ত, জলবসন্ত বা হামের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের প্রাথমিক উপসর্গগুলির মিল রয়েছে। তবে একমাত্র এই সংক্রমণের ক্ষেত্রেই লিম্ফাডেনোপ্যাথি দেখা যায়। সাধারণত জ্বর আসার এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ত্বকে গুটি দেখা দিতে পারে। সাধারণত মুখেই বেশি গুটি বেরোয়। এরপর হাতের তালু ও পায়ের পাতায় গুটি বেরোয়। চোখের পাতায়ও গুটি বেরোতে দেখা যায়। অত্যন্ত চুলকানো ও ব্যথাদায়ক এই ফুসকাগুলো ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়। প্রথম পর্যায়ে গুটিগুলি ফোসকা অবস্থায় থাকে। ধীরে ধীরে স্ফীত হয়। পরের ধাপে ফোসকাগুলো স্বচ্ছ জলীয় পদার্থ ভরে ওঠে। এরপর সেই ফোস্কার মধ্যে হলুদ রঙের জলীয় পদার্থ জমা হয়। পরে উপরের অংশটি খোসার মতো শুকিয়ে যায় এবং খসে পড়ে। এর ফলে দাগ সৃষ্টি হতে পারে। মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তারপর নিজে থেকেই সেরে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে রোগটির জটিল আকার ধারণ করার সম্ভাবনা বেশি। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি থাকলে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা কী?
এই মুহূর্তে মাঙ্কিপক্সের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধে কাজ হতে পারে, কিন্তু মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি। তবে যেহেতু মাঙ্কিপক্স স্মলপক্স ভাইরাসজনিত তাই চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা টিকা ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালে মাঙ্কিপক্সের প্রতিষেধক হিসেবে ‘জিনিওস’ নামে একটি টিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য অনুমোদিত হয়েছিল। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত হয় ‘টেকোভিরিম্যাট’ নামের একটি অ্যান্টিভাইরাল যা বিশেষত গুটিবসন্ত এবং মাঙ্কিপক্স এর মতো অর্থোপক্স ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মাঙ্কিপক্স চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত। গুটিবসন্তের টিকা ৮৫% কার্যকারিতাসহ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। পূর্বের স্মলপক্সের টিকা দিয়ে মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস থেকে সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পৃথিবী থেকে ভাইরাসজনিত স্মলপক্স রোগ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। একারণে এই টিকাগুলো সহজলভ্য নয়। একারণে আমাদের সচেতনতাই পারে এই রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসর্গ দেখা দিলে করণীয় কী?
- প্রথমেই এই রোগের উপসর্গ দেখলে পরীক্ষা করাতে হবে। জ্বর, ক্লান্তি, শরীর ব্যথা, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ত্বকে ক্ষত তৈরির মতো উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
- মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ সাধারণত সংক্রমণের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেখা যায়। যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন, তবে আগে থেকেই আলাদা থাকা ভালো। তাতে বাকিদের মধ্যে সংক্রামণের ঝুঁকি কমবে।
- গোসলের গামছা, তোয়ালে আলাদা করতে হবে। যতক্ষণ না পরীক্ষার ফল হাতে আসে, ততক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে।
কীভাবে মাঙ্কিপক্স এড়ানো সম্ভব?
- যে প্রাণীর শরীরে এই ভাইরাস থাকতে পারে, তার প্রত্যক্ষ ছোঁয়া এড়িয়ে চলুন।
- যেকোনো অসুস্থ প্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
- কেউ আক্রান্ত হলে তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখুন।
- আক্রান্ত প্রাণী বা ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে হাত পরিষ্কার রাখুন।
- নিয়মিত সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে রাখুন।
- অসুস্থ মানুষের পরিচর্যা করার সময় পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) ব্যবহার করুন।
মাঙ্কিপক্স কি নিরাময়যোগ্য?
সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গগুলি নিজে থেকেই সেরে যায়। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত অনেকেরই চিকিৎসার দরকার হয় না। তাঁরা নিজে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠেন। রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসকরা রোগীর পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রাখেন। রোগীর শরীরে যাতে পানি শূন্যতা দেখা না দেয় তা নিশ্চিত করেন। এরপর রোগের উপসর্গগুলিকে কমাতে চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ হলে তা আটকাতে অ্যান্টিবায়োটিক দেন।
মাঙ্কিপক্স নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। এখনও অবধি এই রোগের সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ভারত, ভিয়েতনাম, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটেন এবং আমেরিকায়। তবে কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাস যেমন বায়ুবাহিত হতে পারে, মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস তেমন নয়। ফলে এই ভাইরাসের বিস্তার, সংক্রমণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। এই রোগটি স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের মতোই, তবে তুলনায় কম প্রবল। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহরসের মাধ্যমেই মাঙ্কিপক্স ছড়ায়। এই রোগটি কোভিড-১৯ বা হামের মতো বায়ুবাহিত নয়। স্মলপক্সের টিকা যেহেতু আংশিকভাবে হলেও এই রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। তাই এখনই এতোটা উদ্বেগের কারণ নেই। কোভিড প্রতিরোধে যে স্বাস্থ্যবিধিগুলি রয়েছে সেগুলো মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে।
মাসুদুর রহমান 




















