মানিকগঞ্জ জেলার আলোকদিয়া চর, যেখানে এখনো পৌঁছায়নি আধুনিকতার ছোঁয়া। শিক্ষা, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার নূন্যতম সুবিধা না পাওয়া সেই চরের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন ।
শীতের তীব্রতায় বিপর্যস্ত আলোকদিয়া চরের অসহায় মানুষেদের শীতবস্ত্র, চিকিৎসা সেবা প্রদান ও বিনামূল্যে ওষুধ সামগ্রী বিতরণ করেছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
যমুনা পাড়ের আসহায় ছিন্নমূল মানুষগুলো একটু উষ্ণতা পাওয়ার আশায় সকাল থেকেই রঘুনাথপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠে ভিড় করেন।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে, প্রকৃতি ও জীবন স্বাস্থসেবা কেন্দ্র এবং প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের সহযোগিতায় সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম। একটানা চলে দুপুর ২ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত । নারী, শিশু, বয়স্ক সবাই লাইন ধরে শীতবস্ত্র গ্রহণ করেন।
একদিকে যখন শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম চলছিল ঠিক তার পাশেই দীর্ঘ লাইন চিকিৎসা নিতে আসা চরাঞ্চলের দুঃস্থ মানুষদের। শীত আসলে চরের মানুষদের কষ্ট যেন একটু বেড়ে যায়। তীব্র শীতে এমনিতেই জনজীবন বিপর্যস্ত তার সাথে রয়েছে নানা রকমের অসুখ-বিসুখ। এইসব প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে চিকিৎসাসেবা পাওয়া সোনার হরিণ। মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দুই বেলা খাবার জোগাতেই রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কেনা রীতিমতো বিলাসিতা। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ চরবাসীর জন্য যেন এক আশীর্বাদ।
শীতবস্ত্র বিতরণ, স্বাস্থসেবা প্রদান ও বিনামূল্যে ওষুধ সামগ্রী বিতরনের জন্য দুর্গম প্রত্যন্ত চর গুলোকে বেছে নেওয়ার কারণ উল্লেখ করে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, এই চরগুলোতে সেভাবে সাহায্য সহযোগিতা এসে পৌঁছায় না। শহরের আশেপাশে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যতটা সহজ, দুর্গম চরাঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা ততটা সহজ না। এইযে দুর্গম চর যেখানে একেবারেই হতদরিদ্র মানুষরা থাকেন, জীবনসংগ্রাম করে বেঁচে থাকেন কারণ তাদের খুব বেশি সহায়-সম্বল নেই। মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।
মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, আমরা যারা শহরে বাস করি এবং উন্নত জীবন যাপন করি। আমরা যদি এই অসহায় মানুষের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে সরকারের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব না। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই যে চরের মানুষগুলো এদের চাহিদা খুব বেশি না। খুবই সামান্য চাহিদা এদের। আমরা সবাই যদি এক হই, একসাথে এগিয়ে আসি তাহলে এই চরের মানুষদের চাহিদা পূরণে আমাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। আমাদের এই সামান্য সহযোগিতায় তাদের অনেক উপকার হয়।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন প্রতি বছর চর অঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণ, স্বাস্থসেবা প্রদান ও বিনামূল্যে ওষুধ সামগ্রী বিতরণ করে জানান মুকিত মজুমদার বাবু। তিনি বলেন এর মাধ্যমে বিশাল এই জনগোষ্ঠীর সবাইকে সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সম্ভবও না। অন্যরাও যদি এগিয়ে আসে, সবাই যদি এগিয়ে আসে তাহলে সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো অনেক উপকৃত হবে। এর মাধ্যমেই মানুষিক আত্মতৃপ্তি পাওয়া সম্ভব। আমরা শুধু ভালো থাকলে হবে না, আমাদের আশেপাশে যারা আছেন তাদের সবাইকে ভালো রাখতে হবে এবং এটা আমাদের দায়িত্ব।
শিক্ষার আলো আলোকদিয়া চরকে আলোকিত করতে না পারলেও শৃংখলা, মানবিকতা আর কৃতজ্ঞতাবোধের কমতি ছিল না এই চরের সাধারণ মানুষগুলোর। প্রবীণদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেলেন, প্রচন্ড ভিড় থাকলেও ছিল না কোনো হুড়োহুড়ি। সবাই লাইন ধরে একে একে গ্রহণ করেন শীতবস্ত্র। কৃতজ্ঞতাবোধ স্বরূপ হাত তুলে দোয়া করেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের জন্য।
মায়ের সাথে শীতবস্ত্র নিতে এসেছিলেন ছোট শিশু। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন অনেক দিন থেকেই। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের ফ্রী মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বিনামূল্যে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
আলোকদিয়া চরে নেই কোন পাকা সড়ক, এখানকার একমাত্র বাহন ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে করেই প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এর সদস্যরা চরবাসীর জন্য নিয়ে এসেছেন শীতবস্ত্র ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী।
তীব্র শীতে কাঁথা গায় দিলে শরীর গরম হয় না, রাতে ঠিক মত ঘুম হয় না। আজকে রাতে একটু শান্তি করে ঘুমোতে পারবো, নতুন কম্বল পেয়ে এমনটাই বলছিলেন এই বৃদ্ধ।
হাড়কাঁপানো শীতে প্রবীণদের কষ্ট বেড়ে যায় কয়েক গুণ। শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। সাথে উষ্ণ কাপড়ের অভাব। সব মিলিয়ে শীত যেন এক আতঙ্কের নাম চরাঞ্চলের মানুষের কাছে। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও শীতবস্ত্র পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল এই অসহায় মানুষেরা ।