প্রকৃতির কাছে যাবেন? সে আবার কেমন প্রশ্ন? মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস। তার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলো প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতিকে ছাড়া বাঁচতে পারে না। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়ে বাঁচতে পারে, মানুষ পারে না। আবার প্রকৃতির মধ্যেও আছে এক রকম তারতম্য। চাঁদে গিয়ে বিরূপ প্রকৃতির মাঝে মানুষের পক্ষে পৃথিবীর অনুকূল প্রতিবেশ রচনা খুব সহজ নয়, কৃত্রিমভাবে সেখানে মানুষকে জীবনধারণ করতে হয়। সেখানে অক্সিজেন, পানি, খাদ্য অর্থাৎ মানুষের জীবধারণের মতো পরিবেশ নেই। কোনো কালে থাকলেও থাকতে পারে, তাও আমরা জানি না। এই না-জানাটা আমাদের জ্ঞানের অপূর্ণতা। অপূর্ণতাও মানবোচিত; মানুষ জ্ঞানের শেষ সীমায় বা কাছাকাছি চলে গেলে পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটে যাবে। আর তাও খুব দূরে নয়- জানা যাবে।
আইনস্টাইনের আলোর গতির তত্ত্ব এখনো নির্ভুল। সৃষ্টির জন্য একজন মহাপ্রভুর দরকার? এখন তার দরজায় নতুন করে করাঘাত পড়েছে। জাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন, মানুষের জন্মের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ডারউইন কি বলেছেন? মানুষ তো জীব হিসেবে সৃষ্টি হয়নি। মানুষ হচ্ছে প্রাণীর বিবর্তিত রূপ। এমনও হতে পারে বিবর্তনের ধারায় প্রাণ ধারনের জন্য মানুষও আবার বিবর্তিত হবে। এলিয়েন সম্পর্কে যে ধারণা মানুষের তারাই হয়ত ভিন্ন গ্রহের মানুষের বিবর্তিত রূপ। এই পৃথিবীতে না হোক, অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা তারা। অন্তত নক্ষত্রবীথির মাঝে পৃথিবীর মতো গ্রহ যে আছে তা আমরা জেনেছি। সেই সব গ্রহের মধ্যে কোথাও না কোথাও প্রাণ আছে, মানুষের মতো প্রাণী আছে, বুদ্ধিতে তারা মানুষের চেয়ে খাটো নয়। কিন্তু এসব এখনো প্রমাণিত সত্যরূপে গৃহীত হয়নি বলে আমাদের বিশ্বের বর্তমান প্রকৃতি নিয়েই আমরা মগ্ন। শুধু মগ্ন নই, বিপন্নও। আবার বিপন্ন জেনেও অসহায়। কারণ বিপন্নতার জন্য যারা দায়ী তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না, এমনকি তার নিজের পরবর্তী প্রজন্মের কথাও ভাবে না। এখানেই মানবজাতির সমস্যা। ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, সরকার, সাধারণ মানুষ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে রাজ্যপাট চালিয়ে যাচ্ছে। আদিকাল থেকে, অনাদিকাল থেকে।

প্রকৃতির মধ্যেও আছে যোগ্যতমদের বেঁচে থাকার খেলা বা লড়াই। মানুষের মধ্যেও আছে ক্ষমতাবান, ধূর্ত, শঠ ও চালবাজদের টিকে থাকার চেষ্টা। সাধারণ সৎপ্রকৃতির মানুষ চায় স্থিরতা, প্রকৃতির সঙ্গে সহমর্মিতা বা প্রশংসা। পূজাও করেন কেউ কেউ। পীর-দরবেশদের আস্তানায় দেখা যায় গাছপালা, পুকুর ও নির্জন আস্তানা। এমনকি শহরের ভিড়ের মধ্যেও দেখা যায় ধর্মস্থানে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাধারণ মানুষও ঘরের আশপাশে, বারান্দায়, ছাদে গাছপালা বা টবের সমাবেশ করে। যেমন একটি আজেলিয়া বা ক্যামেলিয়া, মধুমালতী বা মাধবী, রাতের রাণী বা কুমারী অপরাজিতা ফুল। শিউলি- বকুলের জন্য জায়গা দরকার। সুখদর্শন বা ব্যাঘ্রলিলির জন্য টবই যথেষ্ট। এমনকি স্বর্গের পাখির মতো দুর্লভ ফুলও টবে হয়। জুঁই থেকে বেল ফুল, সুষমা (ব্রনফেলসিয়া) থেকে দশ-বিশ রকমের জুঁই বা জেসমিন অথবা কুর্চি, কেতকি বা কেয়া, মল্লিকা বা বেল ফুল, ঝুমকোলতা- সবই টবে চাষ করা যায়।
শুধু আপনাকে জানতে হবে পরিচর্যা ও তার সুলুক সন্ধান। রঙ্গন, রাধাচূড়া, মাকড়সা লিলি, ব্যাঘ্রলিলি, গ্লোরিয়া বল, শিটি, হলুদ, আদা, দোলনচাঁপা টবের জন্য আদর্শ ফুল জানবেন। হে অনুরাগী ফুলপ্রেমী, ফুল ও মানুষের জীবনের উদ্ভিদকাল অমূল্য। তাকে ব্যর্থ যেতে দেওয়া ন্যায়ধর্ম নয়। ফুলের জীবনের সঙ্গে মানবজীবনের গভীর গূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এই রহস্য জানা বা চেনা চর্চার বিষয়। ভালোবাসা থেকে সিদ্ধি লাভ সবই চর্চার বিষয়। অনেক মৌমাছি ও ভীমরুলের চেষ্টায় অত বড় চাক হয়, সুরম্য বাসা তৈরি হয়। লুই কান বা কামরুল হাসান, ভ্যানগক বা মার্কেজ, আমার নবীন পাঠিকা কি একদিকে বেগম রোকেয়া বা আরিওসি সারাওকা হতে পারবে না। চন্দ্রমল্লিকার গোটানো পাপড়ির সৌন্দর্য নির্ভুল সৌন্দর্যের আধার। ফুলের পাপড়ির উপর মুক্তোর মতো শিশিরবিন্দু আর কান্নারত শিশুর অশ্রু সাহিত্য শিল্প বা গানের বাণী হয়। সঙ্গীতরে ‘সা রে গা মা পা ধা নি’ অর্থাৎ ষড়–জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ এই সাতটি স্বরকে স্বপ্তস্বর বলা হয়। সাতটি শুদ্ধ স্বর রূপে কথিত। ষড়জ, ঋষভ প্রভৃতি সপ্তস্বরের পূর্ণ নাম। এই সাত সুর যথাক্রমে ময়ূর, ষাঁড়, ছাগ, ক্রৌঞ্চ (বক), কোকিল, অশ্ব ও হাতি এই সাত রকম জীবের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি থেকে গৃহীত বলে প্রাচীন সঙ্গীতালোচনায় উল্লেখ পাওয়া যায়। মতান্তরে ময়ূর, চাতক, ছাগ, কোঁচ, বক, কোকিল, অশ্ব ও হাতি। অর্থাৎ জীবজগতের কণ্ঠ থেকে সুর আহরণ করেছে মানুষ। হাতির আছে মধুর সুরেলা গলা। ঘাঁড়ের গম্ভীর নিনাদ থেকে ‘সা’ পেয়েছি। ছাগল বললে তুচ্ছ করার আর কারণ নেই! কোঁচ বক আজকাল দেখাই যায় না। বছর পাঁচেক আগে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের পাড় বাঁধাই করে দেওয়ার আর সেই একটি নিঃসঙ্গ কোঁচ বককে দেখতে পাই না। সেই সঙ্গে মাছরাঙা ও চিল গোত্তা খেয়ে উড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য হয়ে গেছে অদৃশ্য।

পাড় বাঁধাই করে দিলে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায় ও পুকুরের জীব এবং অনুজীবের মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি অনেক প্রাণী ও পাখি নামতে পারে না। পাখিদের স্নান করার সুন্দর দৃশ্য হারিয়ে যায়। ব্যাঙের বাচ্চা দেওয়া বন্ধ। তাই ব্যাঙের প্রিয় খাবার মশার বংশ বেড়ে যায়। কচ্ছপগুলো অর্থাৎ হাতের মুঠোর থেকে ছোট কচ্ছপ ছিল এই পুকুরে। শীতকালে পানিতে কাঠ বা ডাবের খোসা পেলে তার ওপর বসে রোদ পোহাত। তাহলে কী কচ্ছপেরও শীত পায়? নাকি অন্য বিশেষ কারণ যা আমি জানি না! বইও নেই যে জেনে নেব। প্রকৃতির কত কিছু যে জানি না বা বুঝি না বলে এর রস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত। এসব বিষয় আমার গল্প-উপন্যাস ও ভ্রমণলিপিতে লিখি। আর প্রকাশ করতে পারি না বলে নিজের ওপর খুব অভিমান হয়, নাকি ক্রোধ বা হিংসা বলব!
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হানিফ (বর্তমান প্রয়াত) ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারের দীঘির পাড় বাঁধাই করে দিয়েছেন। কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার বা পরিকল্পনাকারীরা পুকুর সংরক্ষণ করে কীভাবে পাড় বাঁধাই করতে হয় জানেন না। একশ’ বছর আগে বলধা গার্ডেনের মালিক নরেন্দ্রনারায়ণ রায় জানতেন। তাঁর শঙ্খনিধি পুকুর সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে’ এবং ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।’- রবীন্দ্রনাথের বর্ষার অসামান্য গান। তাঁর গীতবিতান প্রকৃতি, প্রেম ও বিশ্ব রহস্যের বিশাল ভাণ্ডার। আমার কাছে এই বই রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠতম রচনা। তিনি বলেছেন, বহু যুগের ওপার থেকে আষাঢ় এনেছে মনে। কেন মনে? আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে, আরব সাগর সাঁতওে মৌসুমী বায়ু মালদ্বীপ, মরিশাস, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বার্মায় (মায়ানমার) আসে। বাংলাদেশ ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তো আছেই।

সাতটি পথে ২৬ শে থেকে ১ জুন বাংলা-ভারত উপমহাদেশের সর্ব দক্ষিণে মৌসুমী বায়ু হানা দেয়। গত বছর ৮ জুন মুম্বাইয়ের কাছে লাক্ষা দ্বীপে এসেছিল। সেই হিসেবে দেরিতে এসেছে। আমাদের দেশে আসতে মৌসুমী বায়ুকে আরো কয়েক দিন লেগেছে। সাত দিনও দেরি হতে পারে পথে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসে বলেই কি রবীন্দ্রনাথ ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল’ বলেন নি! আর আষাঢ় এসে গেলে সে হয় বাঁধন ছাড়া, বাঁধনহারা। আমাদের ছেলেবেলায় চট্টগ্রামের আমার ইছামতি গ্রামে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কখনো কখনো একটানা ছয়-সাতদিন বৃষ্টি হয়ে বান হত। বান হতো পাঁচ দিন, থাকত তিন দিন, নেমে যেত ওই দিন তিনেকে। সে কি বৃষ্টি! তখন কী উল্লাস মনে। বান মানে তখন আমার আনন্দ। কলেজে পড়ার সময় নৌকো নিয়ে ঘর পাহারা দিতাম। গুসাই বিলে যেতাম নৌকো নিয়ে। আমার গল্প উপন্যাসে এর কিছু পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছি। আর এখন আরো গভীর বিশ্বাসী হয়েছি- বান মঙ্গলময়, কল্যাণকর। ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি করে। আর বান তো প্রকৃতির সহচর বা সন্তান। আবার কিছু কিছু বানের জন্য মানুষই দায়ী। কর্ণফুলী ও ইছামতি নদীর ভাঙন ও বানের কারণে আমাদের সুবিশাল ভিটে ভেঙে নদীতে মিশে গেছে। আমরা চলে গেছি ছোট্ট নতুন ভিটেয়। হাঁসফাঁস করে আমাদের মন। কুঁকড়ে থাকি অল্প জায়গায়। তবুও আমি নদী ভালোবাসি, বান ভালোবাসি। আমাদের গ্রামের দুটি পাড়া নিশ্চিহ্ন। আমাদের অন্তত চার একর জমি ভাঙনের গ্রাসে উধাও। আমার ছেলেবেলা ও প্রথম যৌবনের ভালোবাসা গ্রাস করে নিয়েছে প্রকৃতি। প্রকৃতি আমাদের ওপর আক্রোশবশত নয় মানুষের কারণে প্রকৃতির এই ভয়াবহতা হয়তো। তবে এখনো পর্যন্ত আবহবিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে গেছে বলে একবাক্যে মানেন না। তারপরও বলব, মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রকৃতি ঠিকই বাঁচতে পারে মানুষ ছাড়া। আর আজও আমি প্রকৃতিতেই বেঁচে আছি, থাকব। হয়তো প্রকৃতির মাঝেই অনাদিকাল!
বিপ্রদাশ বড়ুয়া 



















