বাংলাদেশে আট প্রজাতির বুনো বিড়ালের মধ্যে একটি হলো মেছো বিড়াল। একসময় বাংলার গ্রাম-মফস্বলে মেছো বিড়াল দেখা গেলেও এখন মাছ শিকারি প্রাণীটি রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। আবাসস্থল সংকোচন, জলাধারে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ, হাঁসের খামারের কারণে বাংলাদেশে মেছো বিড়াল-মানুষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রায়ই পত্রিকার পাতায় নিরীহ প্রাণীটিকে নির্মমভাবে হত্যার খবর আসে। মেছো বিড়ালকে বাঘের মতো হিংস্র মনে করে অজ্ঞতাবশত পিটিয়ে মারার প্রবণতা রয়েছে, একই সঙ্গে মাছ- হাঁসের খামারিরাও চড়াও হচ্ছে প্রকৃতির এই সুন্দর সম্পদের উপর। এমন বাস্তবতায় দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবস। দিবসটির প্রতিপাদ্য `জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছো বিড়াল হবে সংরক্ষণ।’
দিবসটি উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা তাই মেছো বিড়াল যে বাঘ নয় এবং প্রকৃতির বন্ধু, এ বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত মেছো বিড়ালের প্রজনন মৌসুমে সংশ্লিষ্ট জনপদগুলোতে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাণীটিকে টিকিয়ে রাখতে আবাস্থল সংরক্ষণ, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সঠিক তথ্যের জন্য গবেষণায় জোর দিয়েছেন বক্তারা।
আজ শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বন ভবনের হৈমন্তী মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘মেছো বিড়াল সংরক্ষণ শুধু প্রাণী অধিকার নয়, এটি পরিবেশ রক্ষার জন্যও জরুরি। বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষায় প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীর ভূমিকা আছে। তাই তাদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। শুধু হাঁস-মুরগি খাওয়ার অভিযোগে মেছো বিড়াল হত্যা অন্যায়। এটি হত্যা চলতে থাকলে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়বে। তাই জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।”
মেছো বিড়াল সংরক্ষণে সরকারের প্রচেষ্টা তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, ‘সম্প্রতি মেছো বিড়াল হত্যার খবর পেয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা মেছো বিড়াল রক্ষায় সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কাজে লাগানো হবে। তবে বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের সম্পৃক্ত করাই বেশি কার্যকর হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমে শুধু হত্যায় দুঃখপ্রকাশ করা খবর নয়, মেছো বিড়ালের পরিবেশগত গুরুত্বও তুলে ধরতে হবে।’
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রচারণায় গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘ অনুষ্ঠানে বাবু ভাই ( প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু) যে তথ্যচিত্র দেখিয়েছেন অথবা আমাদের রেজাউল সাহেব (চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) যে ভিডিওটি দেখিয়েছেন , এগুলো জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দিন, প্রদর্শনের ব্যবস্থা করুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রদর্শনের জন্য জেলা প্রশাসনও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।’
রিজওয়ানা হাসান মনুষ্যত্বের দিকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, এটা আমরা যেন নিষ্ঠুরতা দিয়ে প্রমাণ না করি। সব ধর্মগ্রন্থেই প্রাণীর প্রতি সদয় হতে বলা হয়েছে।’
উপদেষ্টার কথার সূত্র ধরে বন্যপ্রাণী নিধন রুখতে মানুষের ‘মমতা’ জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক হিসেবে তিনি বলেন, ‘খুবই সময়োপযোগী বিষয়ে আজকে আলোচনা হচ্ছে। মেছো বিড়াল এমন একটি প্রাণী যা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। প্রাণীটিকে নিয়ে সাধারণ মানুষ সেভাবে সচেতনও না। এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটি শুরু হলো।’
মাঠপর্যায়ে বন্যপ্রাণী-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রকৃতিবন্ধু বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি আহত মেছো বিড়ালকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত প্রাণীটির পেছনের পাগুলো শক্তি হারিয়েছে। মেছো বিড়ালটিকে সুস্থ করতে দরকার উন্নত চিকিৎসা, নিবিড় পরিচর্যা এবং এজন্য লাগবে অবকাঠামো, উন্নত প্রযুক্তি। আর এসবের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন।’
বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। এর সঙ্গে জাতীয় বাজেটে বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আমি মনে করি পরিবেশ, বন, জলবায়ুখাতে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে তাতে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল বাড়ানো যাচ্ছে না। বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় দুঃখজনকভাবে কম। প্রতিবছরই জাতীয় বাজেটে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর বাজেট কমে যাচ্ছে। আমরা যে কাজগুলো করতে চাই সেসব কাজে পর্যাপ্ত অর্থায়ন-লোকবল দরকার। কেবল অনুষ্ঠান-সভা করে পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষা সম্ভব নয়। ’
মিলনায়তনের ডিজিটাল স্ক্রিনে মেছো বিড়াল নিয়ে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তথ্যচিত্রটিতে দর্শনীয় মেছো বিড়ালের পরিচিতি, দারুণ এই প্রাণীর শিকার করার পদ্ধতি, মেছো বিড়াল ও মানুষের দ্বন্দ্ব এবং প্রাণীটির সংরক্ষণ প্রচেষ্টা তুলে ধরা হয়।
বক্তব্য পর্বের আগে মেছো বিড়াল নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো. ফজলে রাব্বী। বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনায় বাংলাদেশে মেছো বিড়ালের বর্তমান অবস্থা, তাদের বাসস্থানের এলাকা, মেছো বিড়াল ও মানুষের দ্বন্দ্বের কারণ, দ্বন্দ্ব নিরসনে করণীয় তুলে ধরা হয়।
বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনায় মেছো বিড়াল যে বাঘ নয় এই বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার আহ্বান জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন নিশাচর নিরীহ মেছো বিড়ালকে বাঘ-চিতাবাঘের মতো আক্রমণাত্মক মনে করে হত্যা বন্ধে জনসচেতনতা অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো মেছো বাঘ যে এলাকায় উদ্ধার হবে সে এলাকাতেই অবমুক্ত করতে হবে, বিশেষ করে স্ত্রী মেছো বিড়ালের ক্ষেত্রে ছানাদের বিষয়টি মাথায় রেখে এই অবমুক্ত করার কথা ভাবতে হবে।
এছাড়া তারা মেছো বিড়াল রক্ষায় আরও কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো মধ্যে অন্যতম হলো: গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচার, মেছো বিড়ালকে জলাভূমির বিশেষায়িত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা, হটস্পট এলাকায় বিশেষ করে শীতকালে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন।
বিশেষ অতিথি বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. মনিরুল এইচ. খান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে দেশের বাইরে থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আলী রেজা খান।
অনুষ্ঠানে মেছো বিড়াল বিষয়ক সচেতনতামূলক পোস্টার ডিজাইন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নটর ডেম কলেজ, রোভার স্কাউট সদস্যসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।