শুক্রবার ছুটির দিন, এর উপর শীত! কিন্তু এর মধ্যেই সকাল সকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। এই ভিড়টা পাখিপ্রেমীদের। প্রতিবছরের মতো ২০২৫ সালেও বসেছে পাখিমেলা। এবার মেলার ২৩ তম আসর। দেশী-পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছরের শুরুর দিকেই এই মেলা বসে বন-বনানী এবং ঝিলে সমৃদ্ধ ক্যাম্পাসটিতে।
সকালে মিলনায়তন প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান।
উদ্বোধনী বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো আয়োজনের মধ্যে অন্যতম পাখি মেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি মেলা ও প্রজাপতি মেলায় ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয়। উপাচার্য মেলার আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরো বলেন, মানুষের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে সাজেকের মতো জায়গায় দৃশ্যমান অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে প্রাণী প্রজাতিও বিতাড়িত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও দৃশ্যমান অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে পাখির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই শীতে যখন পাখিমেলা চলছে, ক্যাম্পাসের জলাশয় গাছে প্রচুর পাখি থাকার কথা থাকলেও নেই জানিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মানুষের পাশাপাশি প্রাণীদেরও মূল্য আছে। আমাদের কর্তব্য থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাণীদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
বরাবরের মতোই এবারও পাখিমেলার সহ-আয়োজক প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন,‘এই শীতে মেলায় সবার যে অংশগ্রহণ দেখছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে সবাই পাখিপ্রেমী। পাখির কলকাকলি, বর্ণিল রূপে আমরা বিমোহিত হই। একটা ছোট্ট পাখি বিষ্ঠার মাধ্যমে বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছ হচ্ছে, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ, আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে সুস্থ রাখছে। পাখির এসব উপকারীতা অনেকের অজানা। তাই পাখি যে কত উপকারী এবং তাদের সংরক্ষণ যে কতটা জরুরি তা জানাতেই এই মেলা।’
পাখি ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকৃতিবন্ধু বলেন, ‘অথচ আমরা পাখি নিধন করছি, খাচ্ছি, শিকার করছি কেবল নিছক আনন্দের জন্য। ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি-পটকা ফুটিয়ে পাখি মারছি। এই যে না বুঝে নানা কর্মকাণ্ড করছি, তাতে প্রকৃতির ক্ষতি করছি। তাই আমরা এই মেলায় পাখি সংরক্ষণে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে বন বিভাগের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু এই ১৮ কোটি মানুষের দেশে কেবল একটি বিভাগের পক্ষে এটা সম্ভব নয়, তাই আপনাদের সবাইকে সাথে নিয়ে একসাথে বন্যপ্রাণী-পাখি রক্ষা করতে পারবো এই আশা নিয়েই পাখিমেলায় এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাখির মাংস খেতে অনেকে ছুটে যাচ্ছেন নগরীর বিশেষ বিশেষ জায়গায়! অথচ এমনিতে ফেসবুকে বলেন পাখি সংরক্ষণের কথা। কেউ কেউ পাখি কেনা-বেচা করেন। বন বিভাগ তাদের প্রতিও কঠোর হচ্ছে। অনেককে আটক করা হচ্ছে।’
পাখির আশ্রম জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসেই এখন পাখির দেখা পাওয়া বিরল। এই বাস্তবতায় মেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘লেকের পাড়গুলোতে বেষ্টনি দেওয়া এবং লেকের পাড়ের দোকানগুলো আছে, সেখানে প্রতিদিনই অনেক লোক পাখিকে বিরক্ত করে। পাখির সিজনটা লেকের পাড়ে মানুষ যাতে পাখিকে বিরক্ত না করে সেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
উদ্বোধনী পর্বের পর স্টলগুলো ঘুরে দেখেন অতিথিরা। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ক্লাবগুলোর সদস্যরা তাদের কার্যক্রম, গবেষণা সম্পর্কে অতিথিদের অবগত করেন।
‘পাখপাখালী দেশের রত্ন, আসুন সবাই করি যত্ন’ প্রতিপাদ্যে দিনব্যাপী মেলায় পাখি দেখা প্রতিযোগিতা, পাখিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশু-কিশোরদের জন্য পাখির ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, টেলিস্কোপ ও বাইনোকুলার দিয়ে শিশু-কিশোরদের পাখি পর্যবেক্ষণ, পাখির আলোকচিত্র ও পত্রপত্রিকা প্রদর্শনী, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পাখি চেনা প্রতিযোগিতা এবং সবার জন্য উন্মুক্ত পাখিবিষয়ক কুইজের আয়োজন করা হয়।
এছাড়াও পাখি শনাক্ত, সংরক্ষণ ও গবেষণায় বিশেষ পুরস্কার। বক্তব্যপর্ব শেষে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেয়া হয় পুরস্কার। এবারের আসরে বাংলাদেশের পাখির উপর উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণের জন্য রাশেদুল করিম রাফাত, শুভঙ্কর বিশ্বাস ও সাইদ হোসাইন ‘বিগ বার্ড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। গণমাধ্যমে পাখি বিষয়ক সচেতনতার জন্য প্রিন্ট ক্যাটাগরিতে আশিকুর রহমান সমী, অনলাইন ক্যাটাগরিতে মো. ইমন ইসলাম, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ক্যাটাগরিতে শামিম হাসান সীমান্ত কনজারভেশন মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য স্পেশাল রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট (ডব্লিউসিসিইউ) ও বাংলাদেশ বন বিভাগ।
মেলার অন্যান্য সহ-আয়োজকদের মধ্যে ছিল ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টার, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, আরণ্যক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতি, আউইউসিএন এবং বাংলাদেশ বনবিভাগ।