ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার পূর্বে ব্রাহ্মণকান্দা। সেখান থেকে আরও এক কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে সাতগাছি বন। ধূলোমাখা মেঠোপথের ধারে কয়েক বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছিল ছোট সবুজ এক অরণ্য। পাশাপাশি বেড়ে উঠা বট, পাকুড়, শিলকড়ই, বাবলা, তাল, অর্জন আর হরতকীর গাছ নিয়ে এখানকার জঙ্গল। এ সাতটি গাছের নামের সাথে মিল রেখেই হয়তো জায়গাটির নাম হয়েছিল সাতগাছি। সাত প্রজাতির গাছ ছাড়াও এখানে ছিল ছোট ছোট ঝোপ। ঝোপের আড়াল গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর থেকে যখন পাখির কূজন ভেসে আসত, যে কেউ মুগ্ধ হয়ে সাতগাছির প্রেমে পড়ে যেত। বয়সী গাছগুলোর মধ্যে দেখার মতো ছিল বট-পাকুড়ের গাছ। প্রায় দুই বিঘা জায়গাজুড়ে গাছ দুটি এমনভাবে বেড়ে উঠেছিল যে একটি থেকে অপরটি আলাদা করা যেত না। ক্লান্ত পথিক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে শুনত নানা প্রজাতির পাখির গান। সাতগাছির বনে এক লাইনে দাঁড়িয়েছিল তিনটি তালগাছ। গাছের পাতার সাথে বাবুই পাখির বাসা আমাকে খুব টানতো। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, এমন সুন্দর করে ওরা বাসা বানায় কীভাবে? তালগাছে কতগুলো বাসা আছে একবার গুনতে গিয়ে ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। একটি তাল গাছের ৪৯টি বাসা পর্যন্ত গুনতে পেরেছিলাম। বাকিগুলো আর পারি নি।

পাশেই সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল দুটি শিলকড়ই গাছ। ওই গাছে কেবল বাজ আর চিল বাসা বাঁধত। সেখানে আর কেউ ঘর বানাতে সাহস পেত না। বাজ পাখি যখন তার বাসায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াত তখন রাজা-বাদশাদের কথা মনে পড়ত। আট থেকে দশটি বাবলা গাছের প্রতিটি শাখায় ছিল শালিক আর চড়–ই পাখির বাসা। অর্জন গাছে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকত পেঁচা। ওদের দিকে নজর পড়লেই বুকে ভয় ধরে যেত। বট-পাকুড়ের গাছের প্রতিটি পাতায় পাতায় বাস করত ঘুঘু, বক, কাক, কোকিল, কবুতর, টুনটুনি, দোয়েল আর হলুদরঙা পাখি। পাখি বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা না থাকায় অনেক পাখি চেনাও হত না। কোনোটির দেহ অতি ক্ষুদ্র কিন্তু লেজটি ছিল ধবধবে সাদা এবং ফুট দুয়েক লম্বা। কোনোটির আবার গা ছাইরঙা কিন্তু ফুট খানেক লম্বা কালো লেজ চিকচিক করত। গলায় মালা পরা ঘুঘুর দিকে তাকিয়ে মনে হত এমন একটা মালা যদি আমার থাকত!

সাতগাছি বনের একটু দূরে ছিল তীর তীর করে বয়ে চলা সাতগাছি খাল। আশপাশে প্রায় ১ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি ছিল না। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতেই সময় কাটাতে চারপাশের মানুষ চলে আসত সাতগাছি বন ও খালের ধারে। প্রকৃতিকে মন ভরে দেখত তারা। সূর্য ডুবে গেলে গা ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি হত। বছরে একবার মেলা বসত বট-পাকুড়ের গাছের নিতে। দূর পথ থেকে মানুষ আসত নানা সওদা বেচাকেনা করার জন্য। গ্রামীণ উপকরণে সাজানো মেলায় যেমন নানা উপাদেয় খাবারের পসরা থাকত তেমনি ঘর গৃহস্থালির কাজে নিত্য ব্যবহৃত সামগ্রীও মিলত। মানুষ মেতে উঠত বাঙালিয়ানায়, বাড়ত সামাজিক হৃদ্যতা।
প্রায় ৩৫ বছর পর সেদিন গিয়েছিলাম সাতগাছি। জায়গাটি আর আগের মতো নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে গড়ে উঠেছে জনবসতি। সেই বন আর নেই। শতবর্ষী কোনো গাছও নেই। হারিয়ে গেছে সাতগাছি খাল। কোনোকালে বন-খাল ছিল এমন কোনো চিহ্নও নেই আজ। দেশি প্রজাতির গাছের বদলে বাড়ির আনাচ-কানাচ দখল করে নিয়েছে ভিনদেশি আগ্রাসী প্রজাতির গাছ। বন্য নির্জনতা হারিয়ে মানুষের কোলাহলে আজ ব্যস্ত এক মহল্লা। এমননি করেই সাতগাছির বন হয়ে যায় গ্রাম। গ্রাম হয়ে যায় মহল্লা। মহল্লা হয় শহরতলী। আর শহরতলী দিনে দিনে রূপ নেয় প্রকৃতিহীন এক ইট-পাথরের বস্তিতে। আর ময়লা জমে আমাদের হৃদয়ের অলিগলিতে। আমরা তখন প্রাণহীন পৃথিবীর বাসিন্দা!
সৈয়দ খায়রুল বাশার 



















