দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে অসংখ্য হিমবাহ, যার কারণে পৃথিবী জুড়ে ২০০ কোটির অধিক মানুষের খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিতে পারে – এমনই আশঙ্কা কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ।
হিমবাহের এই অভূতপূর্বভাবে গলে যাওয়া আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট সেচনির্ভর কৃষির দুই-তৃতীয়াংশ, কোনো না কোনোভাবে হিমবাহ সংকোচন এর দ্বারা প্রভাবিত হবে।
পৃথিবীতে একশো কোটির বেশি মানুষ পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এমন অঞ্চলে বসবাসকারী অর্ধেকেরও বেশি মানুষ, ইতোমধ্যেই খাদ্য সংকটে ভুগছে।
ইউনেস্কোর মতে, এসব অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন মূলত পার্বত্য জলাধার, গলিত তুষার ও হিমবাহ নির্ভর হওয়ায়, ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হতে পারে।
উন্নত দেশগুলোও এই ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে কলোরাডো নদীতে ২০০০ সাল থেকে খরা চলছে। উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে বরফের পরিবর্তে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে, যা দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় খরা আরও বাড়ছে।
ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলে বলেন, “আমরা কোথায় থাকি সেটা বড় কথা নয়। পরোক্ষভাবে হলেও, আমরা সবাই পর্বতমালা ও হিমবাহের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক পানির টাওয়ারগুলো এখন তাৎক্ষণিক বিপদের মুখে। আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হিমবাহের পরিবর্তনের হার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। গত তিন বছরে হিমবাহের ভর হ্রাসের হার রেকর্ড সর্বোচ্চ। নরওয়ে, সুইডেন, এবং ক্রান্তীয় অ্যান্ডিজ অঞ্চলে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
পূর্ব আফ্রিকার কিছু স্থানে ৮০% হিমবাহ ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। অ্যান্ডিজ পর্বতমালায় ১৯৯৮ সালের পর থেকে এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত হিমবাহ গলে গেছে। ইউরোপের মধ্যে আল্পস ও পিরিনিজ পর্বতমালায় হিমবাহ প্রায় ৪০% হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়াও, বরফের ওপর বৃষ্টিপাত তুষারধস সৃষ্টির প্রধান কারণগুলোর একটি হওয়ায়, এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে।
গলিত বরফের পানি একত্রিত হয়ে হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি করতে পারে, যা উপত্যকা বা ঢালুজাতীয় স্থানের নিচের অংশে বসবাসকারী মানুষদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
“নেচার” জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থামানো না যায়, তবে শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক হিমবাহ হারিয়ে যাবে।
ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক জরিপের হিমবাহ ভূতাত্ত্বিক, অ্যালেক্স ব্রিসবর্ন বলেন, “পর্বতের হিমবাহগুলো পৃথিবীর বৃহত্তম মিঠা পানির ভাণ্ডারগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মকালে গলে যাওয়া বরফ একশো কোটিরও বেশি মানুষের পানির চাহিদা মেটায় এবং কৃষি ও শিল্পখাতের বিশাল অংশকে টিকিয়ে রাখে। এই গলনের প্রভাব শুধু হিমবাহের নিচে থাকা অঞ্চলেই নয়, বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।”
এই প্রভাব এমন এক সময়ে আসছে, যখন অনেক খাদ্য উৎস ইতোমধ্যেই চাপে রয়েছে। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (IFAD)-এর প্রেসিডেন্ট আলভারো লারিও বলেন, “পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠে। পর্বতমালা আমাদের ৬০% মিঠা পানি সরবরাহ করে। কিন্তু যারা এই মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করে, তারা নিজেরাই সবচেয়ে বেশি খাদ্য সংকটে ভুগছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের এখনই বিনিয়োগ করতে হবে তাদের সহনশীলতা গড়ে তোলার জন্য, যাতে হিমবাহ, নদীনালা এবং তার সাথে আমাদের সবার ভাগ্য রক্ষা করা যায়।”