আজ দেশের উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর স্মৃতি জাগানিয়া ভয়াল দিন, ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সর্বত্র। ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন। নিঃস্ব হয়ে পড়ে হাজারো পরিবার।
কী নাম ছিল ঘূর্ণিঝড়টির?
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতসহ এই অঞ্চলে যেভাবে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় সেরকমভাবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করা হয়নি। এই অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা শুরু হয়েছে সম্মিলিতভাবে ২০২০ সাল থেকে। ওই বছর এ অঞ্চলের মোট ১৩টি দেশ থেকে ১৩টি নামসহ মোট ১৬৯টি নাম সামনের বছরগুলোর জন্য প্রকাশ করা হয়।
এর আগে পশ্চিমা আবহাওয়া সংস্থাগুলোই ভারত মহাসাগর ও আশপাশের ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম দিতো। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশে আঘাত হানা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়টির নাম দেয়া হয়েছিল 2B, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের নামকরণের অংশ হিসেবে এই নাম দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমানবাহিনীর যৌথ কমান্ডে চলা জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার।
আবার মার্কিন আর্মি নথিপত্র এবং ইউএসএইড এর তথ্যানুসারে এই একই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল ম্যারিয়েন। টাইম ম্যাগাজিন বাংলাদেশে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়েছিল সাইক্লোন গোর্কি। পশ্চিমা মাত্রা অনুযায়ী এটা ছিল ক্যাটাগরি ফাইভ, অর্থাৎ সুপার সাইক্লোন।
কতটা ভয়াবহ ছিল ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা?
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টির নাম ভোলা সাইক্লোন, যা ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মহাপ্রলয় ঘটানো এই ঘূর্ণিঝড়ের পরেই স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়টিকে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে ধরা হয়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা)। ঘূর্ণিঝড় এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। মারা যায় প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। আর্থিক বিচারে ক্ষতি হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছিল।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহর, আগ্রাবাদ, কাটঘর, বন্দর ও পতেঙ্গা এলাকাও তছনছ হয়ে যায়। বন্দর থেকে ছিটকে যায় নোঙর করা জাহাজ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নৌবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায়। ভেসে যায় নৌ ও বিমানবাহিনীর অবকাঠামো, ক্ষতিগ্রস্ত হয় উড়োজাহাজ। জলোচ্ছ্বাসে অনেক সদস্য পরিবারসহ আটকা পড়েন, হারিয়ে ফেলেন প্রিয়জনকে।
আজও তাড়া করে ভয়াল সেই স্মৃতি
আজও সেদিনের ভয়াল স্মৃতি তাড়া করে ফেরে উপকূলবাসীদের। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বাঁশখালীতেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। ওই উপজেলার বাসিন্দারা এখনও ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা শওকত আরা বেগম (৫৬) হারিয়েছেন তার তিন ছেলেমেয়েসহ দশ স্বজনকে। সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল গৃহবধূ শওকত আরার পুরো সংসার। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটে তার। আজও খুঁজে পাননি ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া তিন সন্তানের লাশও।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার খুদিয়ার টেক এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহমদ বলেন, ‘সেই রাতে ছেলে হারায় মাকে, মা হারায় তার প্রিয় সন্তানকে। আমার পরিবারের ১৫ জন সদস্য চোখের সামনেই ভেসে গিয়ে প্রাণ হারায়। এই স্মৃতি কোনো দিন ভুলতে পারবো না।’
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন বিকেল থেকে বইতে থাকা দমকা বাতাস প্রবল এক ঝড়ের আভাস দিচ্ছিল। সে সময় সন্দীপে নিজের বাড়িতে ছিলেন জান্নাতুল নাইম শিউলি । তখন বয়স ছিল তার ২২ বছর । রাত বারোটার দিকে তাদের ঘরে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকতে থাকে । একই সাথে প্রচণ্ড বাতাস। তখন বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন শিউলী।
শিউলী বলছিলেন ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন বাড়ির আশপাশে তিনি যে চিত্র দেখেছিলেন সেটি ছিল মর্মান্তিক। তিনি বলেন, ” শুধু কান্নার শব্দ শুনতেছি। যেদিকে যাই শুধু লাশ। আমাদের পাশের এক বাড়িতে একসাথে ত্রিশ জন মারা গেছে।”
কেন এত প্রাণহানি?
৩৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রাতের বিভীষিকা ভুলতে পারেন না উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। সেই রাতে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি, কেউ কেউ তথ্যও পাননি। সেসময় আবহাওয়া বিভাগ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করলেও সচেতনতার অভাবে অনেকে রয়ে যান নিজ ঘরে।
সেই ভয়াবহতা থেকে বেঁচে যাওয়া সন্দীপের শিউলী বলেন, সতর্ক বার্তা শুনলেও তারা সেটিকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেননি।
“বিভিন্ন সংস্থার লোকজন মাইকিং করতেছিল। বলছিল যে মহাবিপদ সংকেত। উপকূলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার জন্য বারবার বলতেছিল। কিন্তু কোন মানুষ সেটাকে পাত্তা দেয় নাই। অনেকে বলছে ১০ নম্বর সিগনালে কিছু হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন সন্দীপের তৎকালীন বাসিন্দা শিউলী।