বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো ‘মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন। নদী রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর সাংবাদিকতা ক্যাটাগরিতে সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুর রহমান।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পানি ভবন অডিটোরিয়ামে এই অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিকতা ক্যাটাগরিতে দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুর রহমানের পাশাপাশি গবেষণা ক্যাটাগরিতে মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওর্য়াড পেয়েছেন হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া ও সংগঠন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
পুরস্কার প্রাপ্তিতে অনুভূতি প্রকাশ করে জাহিদুর রহমান বলেন, নদী রক্ষা বা পরিবেশ সংরক্ষণের সংবাদ সংগ্রহের কাজে আমাদের সবচেয়ে বেশি যে প্রতিবন্ধকতা, কোনো দিক থেকেই সহায়তা পাওয়া যায় না, সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের পরিবেশ কর্মী (মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান) সব সময় আমাদের খোঁজখবর রাখেন। তার সহযোগিতার কারণে সংবাদপত্রে নদী নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে।
জাহিদুর রহমান বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আমরা যখন কাজটা করি, যেদিন সংবাদটা প্রকাশ হয়, সেদিন আমাদের যতটা আনন্দিত হওয়ার কথা, ততটাই আতংকিত থাকা লাগে স্বাভাবিকভাবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বা কয়েকদিন পর্যন্ত একটা অস্বস্তিতে থাকা লাগে। কারণ যাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হয়, তারা নানা ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। হয় চাকরি খাওয়া, নয় অন্য ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। আপনারা দেখবেন নদী যারা দখলদার তাদের একটা রাজনৈতিকঐক্য আছে। সেখানে কারো কোনো ভেদাভেদ নাই। নদী দখলের ক্ষেত্রে তারা সবাই এক।
সিলেটের পাথর লুটের কথা উল্লেখ করে জাহিদুর রহমান বলেন, কেদ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা সবাই এক হয়ে গিয়েছিলো পাথর লুটের সময়। এতগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে লড়াই করে নদী রক্ষার সংবাদ করা খুব এ কঠিন।
কানাডা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন বিশ্বখ্যাত নদীসংরক্ষক, লেখক ও বক্তা ‘ওয়ার্ল্ড রিভার্স ডে’র প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাঞ্জেলো। আন্তর্জাতিকভাবে নদী রক্ষায় কাজ করা কিংবদন্তি পরিবেশবিদ মার্ক অ্যাঞ্জেলোর অবদান স্মরণ করে ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করা হয়।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইমপ্রেস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত উল্লাহ।
সাংবাদিক জাহিদুর রহমান
জাহিদুর রহমান নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্বচরবাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটিএম লূৎফুর রহমান ও আনোয়ারা বেগম দম্পতির ৭ সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। জাহিদ বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি, একই কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
জাহিদুর রহমান নোয়াখালীর স্থানীয় ‘লোকসংবাদ’ পত্রিকায় ২০০২ সালে ‘তৃণমূল সংবাদকর্মী’ হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। কাজের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে ‘চলমান নোয়াখালী’তে স্টাফ রিপোর্টার এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক ‘জাতীয় নিশানে’ কাজ করেন তিনি। এরপর জাহিদ ২০০৯ সালে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিউজ এজেন্সি ‘ফোকাস বাংলা’য় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ২০১০ সালে তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘শীর্ষ নিউজ ডটকমে’ একই পদে যোগদান করেন। এরপর তিনি ২০১১ সালের শেষের দিকে ‘দৈনিক স্টক বাংলাদেশ’, ‘স্বাধীন মত’ ও ‘বাংলামেইল’-এ সহ-সম্পাদক পদে কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের মার্চে ‘সমকালে’ যোগদান করেন। বর্তমানে জাহিদুর রহমান সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত। সমকালের পাশাপাশি বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন তিনি। জাহিদ সমকাল কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য প্রাণী, ত্রাণ দুর্যোগ, পানি সম্পদ ও এনজিও খাতের সংবাদ কভারেজ করেন।
রিপোর্টিংয়ে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক-২০২০’ পেয়েছেন জাহিদুর রহমান। দেশের গ্রামীণ জীবনযাত্রা নিয়ে অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল প্রতিবেদনের জন্য ‘গ্রামীণ সাংবাদিকতা’ ক্যাটাগরিতে তাকে এই পদক প্রদান করা হয়। সমকালে ‘হাওরের কান্না’ শিরোনামে সমকালে প্রকাশিত চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন পদকের জন্য নির্বাচিত হয়। ২০১৮ সালে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার’ পেয়েছেন দৈনিক সমকালের সহসম্পাদক জাহিদুর রহমান। ২০১৪ সালে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রিন্ট ক্যাটাগরিতে প্রথম পুরস্কার পান তিনি । এর আগে তিনি ২০০৯ সালে ফিচার প্রতিযোগিতায় ‘আলোকিত ফেনী’ পুরস্কার এবং ২০০৪ সালে ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) প্রবর্তিত ‘প্রাকৃতজন’ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের অর্থায়নে রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনের ঋতু প্রকল্প থেকে গ্রহন করেন ফেলোশিপ এবং ২০১৭ সালে সংবাদের সামাজিক প্রভাবের কারণে নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে ইয়ুথ স্কুল ফর সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারস (ওয়াইএসএসই) প্রবর্তিত পুরস্কার লাভ করেন। খাদ্য অধিকার বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের জন্য ২০১৮ সালে জাহিদকে ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে।
বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার অন বাজেট এন্ড পলিসি, পার্লামেন্টারি ওয়ার্কি গ্রুপ অন রাইট টু ফুড ও খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক-(খানি)। ২০১৭ সালে রিয়্যাল এস্টেট বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য ‘আবাসন নিউজ’ বর্ষসেরা সাংবাদিকতা পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২০ সালে জাহিদ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ও ফেলোশিপ পেয়েছেন পান। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইডের ফ্ল্যাগশিপ ‘ইয়াং মিডিয়া ফেলোশিপ ২০২২-২৩’ অর্জন করেছন তিনি। বাংলাদেশে যুব জনগোষ্ঠী নির্ভর এজেন্ডা বাস্তবায়নে অপরিহার্য ভূমিকার জন্য ‘অ্যাকশনএইড মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’ পান সাংবাদিক জাহিদুর রহমান। ২০২৩ সালে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ে গভীরতাধর্মী সেরা সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য জাহিদুর রহমানকে পুরস্কৃত করে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর। এছাড়াও জাহিদুর রহমান ইউএনডিপি, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংস্থার ফেলোশিপ অর্জন করেন। পেশাগত কাজে জাহিদুর রহমান শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড ও আজারবাইজানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।
জাহিদুর রহমান গত এক দশকে মাঠে ঘাটে ঘুরে বাংলাদেশের কৃষি, নদী, পরিবেশ ও গ্রামীণ জীবনের গল্প গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরকার নীতিগত পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে একাধিকবার। জাহিদুর রহমান মনে করেন, কৃষি সাংবাদিকতার মূল দায়িত্ব শুধু তথ্য দেওয়া নয়, বরং পরিবর্তনের পথ তৈরি করা। কৃষি, প্রাণিসম্পদ, পানি সম্পদ, দুর্যোগ ও এনজিও খাত—সব ক্ষেত্রেই তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিশেষভাবে আলোচিত। তিনি মাঠে গিয়ে নদী দখল-দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব, কৃষকের সংগ্রাম সরাসরি তুলে ধরেছেন।নীতিনির্ধারক, গবেষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোই ছিল তাঁর সাংবাদিকতার লক্ষ্য।