বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো ‘মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন। নদী রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর গবেষণা ক্যাটাগরিতে সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পানি ভবন অডিটোরিয়ামে এই অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়।
গবেষণা ক্যাটাগরিতে প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা ক্যাটাগরিতে দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুর রহমান ও সংগঠন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওর্য়াড পেয়েছেন।
অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করে ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, আমি দীর্ঘ দিন নদী নিয়ে কাজ করি, প্রায় ২৫ বছর। অনেক সময় চিন্তা করি, নদী সংরক্ষণ বা পরিবেশ সংরক্ষণের কাজ ছেড়ে দিব। কারণ, এই কাজ করতে গিয়ে এত বেশি প্রেশার, এত বেশি পেইন নিতে হয়, এত বেশি হুমকি নিতে হয়, তখন মনে হয় ছেড়ে দিব। কিন্তু যখন এরকম ভাবে বিভিন্ন সম্মাননা দিয়ে বিশেষায়িত করা হয়, তখন আর ছেড়ে দিতে পারি না।
পুরুস্কার গ্রহণের অনুভূতি জানিয়ে মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড আমাকে বলছে হাত পা বেঁধে আবার নদী সংরক্ষণে নামতে হবে, পরিবেশ নিয়ে নামতে হবে।
কানাডা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন বিশ্বখ্যাত নদীসংরক্ষক, লেখক ও বক্তা ‘ওয়ার্ল্ড রিভার্স ডে’র প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাঞ্জেলো। আন্তর্জাতিকভাবে নদী রক্ষায় কাজ করা কিংবদন্তি পরিবেশবিদ মার্ক অ্যাঞ্জেলোর অবদান স্মরণ করে ২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মার্ক অ্যাঞ্জেলো রিভার অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করা হয়।
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইমপ্রেস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত উল্লাহ।
অধ্যাপক ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া
বাংলাদেশের নদী রক্ষায় গবেষণার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরিতে প্রায় দুই দশক ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রথিতযশা নদী গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে বিএসসি (সম্মান), একই বিভাগের লিমনোলজি অ্যান্ড ফিশারিজ বায়োলজি শাখা থেকে ১৯৯৬ সালে এমএসসি এবং ২০১৬ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া তার কর্মজীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে। হালদা নদীকে কেন্দ্র করে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে ড. কিবরীয়ার একান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় নদীভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। এই প্রতিষ্ঠানে আছে বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি, নদী জাদুঘর ও আর্কাইভ এবং ডিজিটাল কনফারেন্স সেন্টার। ড. কিবরীয়া হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে হালদা নদীতে ডলফিন শুমারি ও ডলফিন মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে বাংলাদেশে প্রথম ডলফিনের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।
হালদা নদীর মা-মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া সাফল্য পেয়েছেন, যা দেশের সার্বিক মৎস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ড. কিবরীয়া নদী নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি নদী সংরক্ষণে বহুমুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এসবের মধ্যে অন্যতম অর্জন পাঠ্য বইয়ে হালদা নদীর অন্তর্ভুক্তি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়ার প্রায় অর্ধশতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০টি আন্তর্জাতিক সেমিনারসহ প্রায় শতাধিক সেমিনারে অংশ নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত আছেন।
নদী রক্ষায় গবেষণার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় পরিবেশ পদক, প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক, বেস্ট রিভার সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী পুরস্কার, দ্য ম্যানথান অ্যাওয়ার্ড সাউথ এশিয়া, চট্টগ্রামের অহংকার সম্মাননা ও উজ্জ্বল অগ্রণী সম্মাননা।