বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল আমার সবচেয়ে প্রিয়। বর্ষার বৃষ্টি আমার মনে জাগিয়ে তোলে ছোটবেলার এক একটি আনন্দঘন মুহূর্ত—যা আজও হৃদয়ে রয়ে গেছে জীবন্ত ছবি হয়ে।
আমার জন্ম ও শৈশব কেটেছে ফরিদপুরের এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা গ্রামে, নাম চরকুমারিয়া। শহরের কংক্রিটের দালান নয়, বর্ষার প্রথম ফোঁটা পড়ত আমাদের ঘরের টিনের চালে। বৃষ্টির সেই টুপটাপ শব্দ যেন এক সঙ্গীত হয়ে বাজত ঘরের কোণে কোণে। আজও যখন বৃষ্টি নামে, মন চলে যায় সেই পুরোনো দিনে।
বৃষ্টি পড়া মাত্রই আমরা পাড়ার সব ছেলে-মেয়েরা ছোটাছুটি করে বাইরে বেরিয়ে যেতাম। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে খেলে বেড়ানোই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় আনন্দ। আমরা ছেলেরা দল বেঁধে মাঠে যেতাম ফুটবল খেলতে। কাদায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বল নিয়ে ছোটার সেই স্মৃতি আজও চোখে ভাসে।
খেলা শেষে সোজা নদীতে ঝাঁপ! আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল একখানি ছোট নদী, ভুবনেশ্বর। বর্ষায় সে নদী ফুলে-ফেঁপে উঠত, আর আমাদের আনন্দের যেন শেষ থাকত না। বর্ষার নতুন পানিতে সাঁতার কাটা, ডুবসাঁতার দেওয়া, খালের ধারে বসে চুপচাপ বৃষ্টির ফোঁটা গোনা—সব ছিল যেন স্বপ্নের মতো।
কখনো কখনো টানা বৃষ্টি হতো, একটানা দুই-তিন দিন ধরে। তখন আর বাইরে যাওয়ার উপায় থাকত না। কিন্তু তাতে কী? ঘরের ভেতরেই শুরু হতো নতুন আরেক রকম খেলা। ভাইবোন মিলে লুডু, পাশা, ষোলগুটি—কত কী যে খেলতাম! মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো, আবার খানিক বাদেই মিল হয়ে একসঙ্গে হাসি-ঠাট্টা চলত। বৃষ্টির এই বন্দী সময়গুলোও আমাদের জন্য এক এক ধরনের উৎসব ছিল।
বর্ষাকালে কোনো কোনো বছর গ্রামে বন্যা হতো। চারপাশে পানি জমে যেত, অনেক জায়গা একে অপরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু সেই বন্যাও আমাদের কাছে ছিল এক রকম রোমাঞ্চ। কলাগাছ কেটে আমরা ভেলা বানাতাম। সেই ভেলা ভাসিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতাম, কখনো কখনো দূরের কোথাও ঘুরতে যেতাম।
বর্ষাকাল মানেই ছিল পুকুরে শাপলা-পদ্মফুল ফোটা, কাঁঠাল-আমের শেষ সময়, ভাপা পিঠা, খিচুড়ি আর ইলিশের ঘ্রাণে ভরে যাওয়া বিকেল। মা কখনো মাটির চুলায় খিচুড়ি রান্না করতেন, জানালার পাশে বসে সেই গন্ধে মনটা ভরে উঠত। বাইরে টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ আর ভেতরে খিচুড়ির ঘ্রাণ—এই দুইয়ে মিলেই বর্ষাকালের সেরা ছবি আঁকা হতো মনে।
আজ এত বছর পর শহরের ব্যস্ত জীবনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি নামে, তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বুজলেই দেখতে পাই সেই মাঠ, সেই নদী, সেই কাদামাটি মাখা ছেলেবেলা। আজও যেন কানে বাজে টিনের চালের সেই চেনা শব্দ। মনটা ভিজে ওঠে না ভিজেও।
বর্ষাকাল শুধু একটি ঋতু নয়, আমার শৈশবের এক অমূল্য অধ্যায়। ভিজে যাওয়া দিনগুলো, কাদামাটির মাঠ, সাঁতার কাটা নদী, খেলাধুলার উল্লাস—সব মিলিয়ে বর্ষা আমার হৃদয়ে এক চিরন্তন আনন্দের নাম।