ষড়ঋতুর দেশে বাংলাদেশে ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে আসে শরৎ। শরৎকাল মানেই নীল আকাশের নিচে ভেসে থাকা সাদা মেঘ আর কাশফুলের ধবধবে সাদা সমারোহ। প্রকৃতির এই ঋতু এসে পৌঁছালে কাশফুলই তার আগমনের নিদর্শন বহন করে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ প্রাকৃতিক দৃশ্যপট থেকে ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করেছে এই অপরূপ শরতের কাশফুল।
শরৎ ঋতু মানেই প্রকৃতির এক অপরূপ রূপের খোঁজ। বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুরই আলাদা রূপ-বৈচিত্র্য রয়েছে, আর শরৎ সেই বৈচিত্র্যের এক বিশেষ অধ্যায়। এই সময়ে সড়কের ধারে, খালি মাঠে এবং নদীর তীর ঘেঁষে কাশফুলের বর্ণিল সমাহার চোখে জুড়ে। নীল আকাশের সঙ্গে মিলিত হওয়া সাদা কাশফুল যেন প্রকৃতিকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে।
শরৎকাল বাংলা বর্ষপঞ্জির ভাদ্র ও আশ্বিন মাসব্যাপী থাকে। বর্ষার ক্রমাগত বর্ষণ শেষে যখন সূর্য তাঁর রোদ্দুর ছড়ায়, প্রকৃতি নতুন রূপে সজ্জিত হয়। আকাশে ভেসে চলে শুভ্র মেঘ, বাতাস হয় অমলিন আর সূর্যের কিরণ দীপ্তোজ্জ্বল। প্রকৃতিপ্রেমীরা এই সময়ে কাশবনে ছুটে আসে, যেখানে চারপাশে কাশফুল, নদীর ধারে মন জুড়ানো বাতাস এবং প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তাদের মনকে প্রশান্তি দেয়।
ঢাকার চারপাশেই এখন কাশফুলের সমারোহ। কালশী থেকে মিরপুর ডিওএইচএস পর্যন্ত সম্প্রতি সংস্কার হওয়া নতুন সড়কের পাশে ফাঁকা জমি ও ঝিল থাকার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসছেন অনেকে। মূলত নতুন রাস্তার পাশে, পল্লবী ডি-ব্লকের ১ নম্বর সড়কের সামনে অবস্থিত মিরপুর আর্মি ক্যাম্প ক্যানটিন থেকে ডিওএইচএসের প্রবেশমুখ পর্যন্তই ভিড় বেশি। আবাসন প্রকল্পের কারণে অনেকের কাছে এই এলাকা ‘সাগুফতা’ নামে পরিচিত।
সড়কের পাশের ফাঁকা জমিতে ফুটেছে কাশফুল। কাশফুলের সঙ্গে ছবি তুলছেন অনেকেই। নিরিবিলি পরিবেশ, গাছগাছালি এবং বসার কিছু স্থান আছে। ঢাকায় পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ভালো জায়গা খুব বেশি নেই। এখানে কাশফুল দেখার সুযোগ এবং খাবারের দোকান থাকার কারণে সুবিধা হয়েছে।ডিওএইচএসের প্রবেশমুখে গড়ে উঠেছে একাধিক দোকান। পাশেই কফির দোকান, যেখানে লোকে কোল্ড কফি বা মিল্কশেকে চুমুক দিচ্ছেন। চটপটি, ফুচকা, গোলা আইসক্রিম, পপকর্নসহ অন্তত ৫০টি অস্থায়ী খাবারের দোকান এখানে দেখা যায়।
উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা বয়সী মানুষ ঘুরতে আসেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারিত প্রকল্পের অংশ এই দিয়াবাড়ী। বিশাল বটগাছ আর তার পাশে রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়ালে বোঝাই যায় না, শহরের কাছে এমন শান্তিপূর্ণ জায়গা আছে। বটগাছের কারণে লোকমুখে এ স্থানটি ‘দিয়াবাড়ী বটতলা’ নামে পরিচিত।
কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় একধরনের ঘাস। এর পালক সদ্য উদ্ভিদের মতো নরম এবং ধবধবে সাদা। চিরল পাতার ধারালো প্রান্ত গ্রাম্য এলাকায় জ্বালানি, ঝাড়ু এবং ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পূর্বে নদীর ধারে ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বেশি দেখা যেত কাশফুল, কিন্তু সময়ের সাথে তার পরিমাণ কমেছে। তবুও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাশফুল মানুষের মনকে এখনও আনন্দ দেয়। কাশফুলের সৌন্দর্য এবং শরৎ ঋতের আবহে অনেকেই ছবি তোলার জন্য কাশবনে যান। কবি নির্মলেন্দু গুন তাঁর কাব্যে লিখেছেন,
শরতের রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে,
কাশবনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে।
প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে,
তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে।
ইচ্ছে করে ডেকে বলি, “ওগো কাশের মেয়ে―
আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে
তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস”।
কাশফুলের আদি নিবাস রোমানিয়া। এই ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ সাধারণত ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, পাহাড় কিংবা গ্রামাঞ্চলের উঁচু স্থানে কাশফুল জন্মায়। বাংলাদেশে ছয় ঋতুর দেশ হওয়ায় কাশফুল ছাড়াও শরতে শিউলি এবং আরও অনেক ফুলের সৌন্দর্য চোখে পড়ে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম শরতের কাশফুল নিয়ে লিখেছেন, “কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি।” জীবনানন্দ দাশও তাঁর ‘শরৎ বন্দনা’ কবিতায় বাংলার প্রকৃতিকে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় বিশেষ উল্লেখ করেছেন।
প্রতিবছর বাংলা ক্যালেন্ডারে শরৎ আসে, কিন্তু শরৎ কখনো একা আসে না। এই ঋতু তার সঙ্গে নিয়ে আসে ভালোবাসা, কাশফুলের শুভ্রতা আর বর্ষার মেঘের অন্ধকার ভেদ করে প্রকৃতি প্রেমিকদের মনে আনন্দের ঢেউ। প্রতিবার শরৎ এসে আমাদের জানান দেয়, ভালোবাসা কাশফুলের মতোই সাদা, সুন্দর এবং মসৃণ।
এদিকে শরতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাস্তার ধারে, খোলা মাঠে ও নদীর পাড়ে কাশফুলের সমারোহ দেখা গেছে। এখানকার শুভ্রতা যেন আকাশের সাদা মেঘকে পেঁজা তুলোর মতো পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কোনো শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত চিত্রে কাশফুল ফুটেছে। রাস্তার ধারে এই অপরূপ দৃশ্য পথচারীর মন আকর্ষণ করছে।
চারপাশে পাহাড়ের পাদদেশ, খালি মাঠ এবং রাস্তার ধারে কাশফুলের বাহার বিস্তৃত। যেন কাশফুলের একটি মেলা বসেছে। কয়েক একর এলাকা জুড়ে ফুলে ঢেকে গেছে। প্রকৃতি প্রেমীরা কাশফুলের সৌন্দর্য ও ছবি তোলার আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসছে। এই সময়ে দেখা যায় অনেক প্রকৃতি প্রেমী কাশফুলের সঙ্গে ছবি তুলছেন এবং প্রকৃতির এই অপূর্ব রূপে মুগ্ধ হচ্ছেন।
আজকের দিনে প্রকৃতিপ্রেমীরা চাইলে সহজেই নিজের নিকটবর্তী কাশবন খুঁজে পেতে পারেন। সঠিক আবহাওয়ার খবর নিয়ে কাশফুলের রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো মানসিক প্রশান্তি এবং ছবির জন্য এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রদান করে।